বধিরের সংলাপ ও পাকিস্তানের বিপর্যয়

ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো
ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো
>

১৯৭১ নিয়ে পাকিস্তানি লেখকদের মধ্যে দ্বিবিধ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। একশ্রেণির পাকিস্তানি লেখক যেকোনো অবস্থায় শাসকদের সব অপকর্মের সাফাই গেয়েছেন। আরেক শ্রেণির লেখক পাকিস্তানি ‘মন’ নিয়েও সত্যাসত্য বিচারের চেষ্টা করেছেন। ইকবাল আখুন্দ ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির লেখক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বে তিনি কায়রো ও বেলগ্রেডে তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই মেমোয়ারস অব আ বাইস্ট্যান্ডার: আ লাইফ ইন ডিপ্লোমেসি এবং আরও কিছু গবেষণামূলক বইয়ের আলোকে এই ধারাবাহিকের প্রথম কিস্তি ছাপা হলো আজ।

১৯৭১ সালে যুগোস্লাভিয়ার দৈনিক পলিটিকার মন্তব্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে ষাটটির মতো যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু কোনোটি বাংলাদেশের যুদ্ধের মতো মানচিত্র বদল করেনি। এর আগে নাইজেরিয়ায় বায়াফ্রার যুদ্ধের পরিণতি ভালো হয়নি। নাইজেরিয়া সামরিক শক্তিবলে সেই বিদ্রোহ দমন করেছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই ভয়ও ছিল অনেকের মনে। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুবিধা ছিল ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অবশ্য অনেক যুদ্ধই মানচিত্র বদল করেছে। এমনকি যুগোস্লাভিয়া ভেঙে কয়েকটি দেশ হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ব তিমুর স্বাধীন হয়েছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ পথিকৃৎও বটে।

 ১৯৭১ সালে ইকবাল আখুন্দ কায়রো ও বেলগ্রেডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতি মিসরের সহানুভূতি ছিল। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে ছিল। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার যে প্রতিশ্রুতি ইয়াহিয়া খান দিয়েছিলেন, তারও বাস্তবায়ন চেয়েছিল দেশটি। সে সময়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে পক্ষে নিতে পাকিস্তান ও ভারত—দুই পক্ষই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রী ফখরুদ্দীন আলী আহমদকে কায়রো পাঠান। আর ইয়াহিয়া খান পাঠান নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মুজাফফরকে। পশ্চিমের মতো অতটা স্পষ্ট না হলেও আরব জনমত পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযান চালানোর পর পাকিস্তানের বিপক্ষেই ছিল। মিসরের প্রখ্যাত দৈনিক আল আহরাম পত্রিকার সম্পাদক হাসনাইন হাইকেল লিখলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানে যখন নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ হলো, তখন আমরা কীভাবে নীরব থাকি?’

অনেকের মধ্যে একটি ধারণা আছে যে আরব বিশ্ব সব ক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল। হাইকেলের মন্তব্য কিংবা মিসরের অবস্থান তা সমর্থন করে না। ১ মার্চ, ১৯৭১, যেদিন ইকবাল আখুন্দ বেলগ্রেডে বদলির প্রেক্ষাপটে কায়রো থেকে করাচি এসে পৌঁছালেন, সেদিনই ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে সেনা পাঠান।

পরবর্তী চার সপ্তাহ যা ঘটেছে, তার সবই ছিল লোক দেখানো। পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দেখলেন, ক্ষমতা হস্তান্তর হলে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানই প্রধানমন্ত্রী হবেন। তাঁকে বসতে হবে বিরোধী দলের আসনে। মন্ত্রী হয়ে রাজনীতিতে আসা ভুট্টোর পক্ষে এটি মানা সম্ভব নয়। তিনি দুই শাসকের অধীনে মন্ত্রিত্ব করেছেন।

২৬ মার্চ ঢাকা থেকে ফিরে ভুট্টো বললেন, ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন।’ কিন্তু এটাই ছিল পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক। ভুট্টো যখন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান করছিলেন তখন ঢাকার বিভিন্ন এলাকা আগুনে পুড়ছিল, ছাত্রাবাস ও বস্তিগুলোতে লাশের স্তূপ পড়েছিল। ভুট্টো যেদিন ঢাকা থেকে করাচি ফেরেন, তার পরের সকালে ইকবাল আখুন্দ তাঁকে টেলিফোন করে জানতে চান, ইয়াহিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রদ্রোহ করেছে। এ জন্য তিনি শুধু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সব দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন কেন?

ভুট্টো সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, শিগগিরই দৃশ্যপট বদলে যাবে। ভুট্টোর প্রত্যাশা রাজনৈতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে জয় করতে তাঁর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সেটি আর কখনোই হয়নি। বেশ কয়েক মাস পর তিনি পঁচিশে মার্চকে ‘দীর্ঘ ছুরিতে বিদ্ধ রাত’ বলে অভিহিত করেন এবং ঘটনার জন্য সরকারের নিন্দা জানিয়েছিলেন। ডিসেম্বরে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে যে সরকার গঠন করেন, তাতে ভুট্টো উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল ‘বাঙালি’ নেতা নুরুল আমিনকে।

বহু পাকিস্তানি মনে করেন, ভুট্টো, একমাত্র ভুট্টোই পূর্ব পাকিস্তান ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী। ইকবাল আখুন্দ এই মত সমর্থন করেননি। তাঁর ভাষায়, যাঁরা সব বিপর্যয়ের দায় চাপাতে একজন বলির পাঁঠা খুঁজছিলেন, তাঁরাই এমন কথাবার্তা বলেন। তবে ভুট্টোর সমালোচকদের যুক্তিও অগ্রাহ্য করা যায় না। সেই সংকটের সময় যদি ভুট্টো যুক্তির পথে থাকতেন, তাহলেও হয়তো পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হতো; কিন্তু পাকিস্তানের মহাবিপর্যয় এড়ানো যেত।

ইকবাল আখুন্দের স্বীকারোক্তি, কায়রো ও বেলগ্রেড তাদের কূটনৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাদের যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর আসতে থাকল, সেগুলোকে অপপ্রচার বলে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া ভাষ্যকে সমর্থন ও প্রচার করা। ইকবাল লিখেছেন, তাঁর সঙ্গে যেসব বাঙালি সহকর্মী ছিলেন, তিনি তাঁদের মনোভাব বুঝতে এবং আস্থায় নিতে চেষ্টা করেছেন। তাঁদের খোলাখুলিভাবে মতামত প্রকাশ করতে দিতেন বলেও জানান এই পেশাদার কূটনীতিক। প্রথম দিকে তাঁর এই সমঝোতা কৌশল কাজে দিলেও পরে আর সফল হয়নি। বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মীরা ক্রমেই দূরে চলে যান। যুদ্ধ শুরু হলে তাঁরা সারাক্ষণ রেডিও সেট নিয়ে বসে থাকতেন, কোথাও বাঙালির বিজয় ও পাকিস্তানিদের পরাজয়ের খবরে উল্লসিত হতেন।

ইকবাল আখুন্দের মতে, পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পকে অভিযান পরিচালনার পর থেকে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় বাহিনী আসা পর্যন্ত সময়টি ছিল বিভ্রান্তিকর ও অন্ধকারময়। কেউ জানতেন না যে পূর্ব পাকিস্তানে সত্যিই কী ঘটেছে। পাকিস্তান সেনা অভিযানের শুরুতে যেসব বিদেশি সাংবাদিককে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল এবং নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম শুধু সরকারি ভাষ্য প্রচার করেছিল, তাতে এই বিভ্রান্তি আরও জোরদার হয়। তবে এত কিছুর পরও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষের খবর অস্বীকার করতে পারেনি। অস্বীকার করতে পারেনি ভারতে অধিক হারে শরণার্থী যাওয়ার ঘটনাও। এ অবস্থায় বিশ্বের প্রায় সব মানবাধিকার সংগঠন, পরিবেশবিদ, সংগীতশিল্পী, এমনকি হলিউড তারকারাও বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন করতে থাকেন। আর পাকিস্তান বরাবরের মতো ‘ভারতীয় ও ইহুদিবাদী চক্রান্ত বলে সত্য আড়াল করতে থাকে, যা তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি প্রভাবশালী দেশে কর্মরত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতদের একটি বৈঠক আহ্বান করা হয় জেনেভায়। এতে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মুহাম্মদ খান। তবে তিনিই এর নিয়ন্তা নন। নিয়ন্তা ছিলেন ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত জেনারেল গুলাম উমর। তিনি জানতে চান, ‘বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি এত খারাপ কেন, আমাদের রাষ্ট্রদূতেরা কী করেন?’ বৈঠক সেখানেই শেষ।

ইকবাল আখুন্দের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, মে মাসে প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক সংক্ষিপ্তসারে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য সাধনে কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেসব বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেননি। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে পাকিস্তান নামটিই অনেকের অপছন্দের। দিল্লিতে এক নৈশভোজে একজন বিদেশি সাংবাদিক যখন জানতে পারলেন, তাঁর পাশের চেয়ারে বসা ভদ্র মহিলা পাকিস্তানি কূটনীতিকের স্ত্রী, তিন তাঁর চেয়ার বদল করলেন।

পাকিস্তানের কূটনৈতিক মহলে যখন এই তৎপরতা চলছিল, তখন জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট, যিনি ছিলেন বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) নাগরিক, পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, অক্টোবর-নভেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। তিনি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছেও তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই বছর গ্রীষ্মে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো দিল্লি সফরে যান। সফর শেষে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসায় আসার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান করা হয়। ইকবাল আখুন্দ লিখেছেন, যুগোস্লাভিয়ার একজন কর্মকর্তা এসে আমাকে জানালেন, তিনি (টিটো) মধ্যস্থতাকারী হতে রাজি আছেন। তাঁর বিশ্বাস, টিটো এটি আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন। ইকবাল আখুন্দ এপ্রিলে যখন তাঁর কাছে পরিচয়পত্র দেন, তখনো তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমরা জাতিগত বিরোধের সমস্যা একবার এবং চিরকালের জন্য সমাধান করেছি।’ তবে সেই সমস্যার যে সমাধান হয়নি, তার প্রমাণ টিটোর মৃত্যুর পর যুগোস্লাভিয়া নামক রাষ্ট্রের বিলুপ্তি।

এরপর ইকবাল আখুন্দ বেলগ্রেডের বার্তাটি ইসলামাবাদে পাঠিয়ে দেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই অনুরোধও জানিয়েছিলেন যে ইরানের রাজতন্ত্রের ২০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইয়াহিয়া ও টিটো তেহরানে যাবেন, সেখানে যেন তাঁদের মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। বৈঠকের ব্যবস্থা হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তা সফল হয়নি ইয়াহিয়া খানের একগুঁয়েমির কারণে। যুগোস্লাভিয়ার একজন কর্মকর্তা, যিনি টিটোর সফরসঙ্গী ছিলেন, ইকবাল আখুন্দকে বলেছেন, বৈঠকে ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে কিছুই বলেননি। পুরো সময়টি তিনি ব্যয় করেছেন ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতি, দ্বৈতনীতি এবং অসদাচরণ নিয়ে। তাঁর ভাষায়, ‘এটি ছিল বধিরের সংলাপ।’

আগামীকাল: মুজিবকে জাতিসংঘে আমন্ত্রণের প্রস্তাব

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]