ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন, কতটা যুক্তিযুক্ত?

কয়েক দিন আগে একটি নিউজ চ্যানেলে একটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। দেশবরেণ্য একজন নাট্যশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন আরেকজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা। সাক্ষাৎকারে তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কাকে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে দেখতে চান?

উনি তখন বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনায় চলে গেলেন। বললেন, পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশ কীভাবে অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছুড়ে ফেলে মৌলবাদী শক্তির উত্থান, স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক সরকারের শাসনামল, এমনকি নব্বইয়ের পর বিএনপির প্রথম ক্ষমতায় আসাকেও সেই অন্ধকার যুগের অন্তর্ভুক্ত করলেন। ওনার মতে, বাংলাদেশ আলোর পথে প্রথম প্রবেশ করল আওয়ামী লীগ ছিয়ানব্বই সালে ক্ষমতায় আসার পর। স্বাভাবিকভাবেই তাই উনি মনে করেন যে ১০ বছর ধরে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে এবং তিনি সেই ধারাবাহিকতাই রক্ষা করতে চান।

তাঁর সাক্ষাৎকারের অনেকখানি জুড়ে তিনি একটা ভয়ের কথা ঘুরেফিরে বারবার বললেন। সেটি হলো আওয়ামী নেতৃত্বের প্রস্থান মানেই হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বের আগমন এবং বিএনপি আসা মানেই জামায়াতের ক্ষমতায়ন। জামায়াত ক্ষমতায় আসা মানেই তিনি মনে করছেন, দেশে তালেবান রাজত্ব কায়েম হবে। তাই তাঁর ধারণা, বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসলে কোনো বিকল্প নেই। এই অভিনেত্রীর আলোচনায় যে ভয়গুলোর কথা ফুটে উঠেছে, সেগুলো একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। সাধারণ মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়তো এই একই ধারণা পোষণ করে। আর এই ধারণা সৃষ্টির জন্য বিএনপির শেষ শাসনামল অনেকখানিই দায়ী।

২০০১ থেকে ২০০৬–এর শাসনামলে বিএনপির প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এ দেশে অত্যন্ত দর্পের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। শুধু তা–ই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রায় সর্বোচ্চ স্তরে তারা পৌঁছে গিয়েছিল। প্রচণ্ড বিতর্কিত জামায়াত নেতাদের মধ্যে দুজন মন্ত্রী–মিনিস্টার হন, তাঁদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ত সেই সময়। এ বিষয়গুলো সাধারণ সচেতন নাগরিকদের জন্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এর দায় অবশ্যই বিএনপি সরকারকে নিতে হবে।

বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে আরেকটি বড় অস্বস্তির কারণ হচ্ছে তারেক রহমানের নেতৃত্ব। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বিএনপির আজকের বেহাল অবস্থার জন্য তারেক রহমানের অবদান অনেক। রাজনীতির ওয়াকিবহাল অনেকেই মনে করেন যে তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে আসার পর দলটির রাজনীতি বেশ হিংসাত্মক হয়ে পড়ে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তারেক রহমানের অজ্ঞাতসারে ঘটেছে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর তাঁর অসীম দুর্নীতির খবর তো সবারই জানা। কিন্তু দুর্নীতির পাল্লা এখন তো মনে হয় সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

যাহোক, জামায়াত আর তারেক রহমানের ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন এই ভয় অনেকেই পাচ্ছেন, অনেক জায়গায় এটিই আসলে জোরেশোরে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে হ্যাঁ, আমরা বুঝতে পারছি যে আওয়ামী শাসনামলে অনেক অন্যায় হয়েছে, ব্যাংক খাতে লুটপাট হয়েছে, গুম হয়েছে, খুন হয়েছে, কিন্তু আমাদের হাতে বিকল্প কী আছে? আওয়ামী লীগের প্রস্থান মানেই হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের আগমন, আর সেটি হচ্ছে জ্বলন্ত উনুন থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে লাফ দেওয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এর চেয়ে বরং ভালো ফুটন্ত কড়াইয়ে থাকা।

এখন কথা হচ্ছে, কোনটা জ্বলন্ত উনুন আর কোনটা ফুটন্ত কড়াই—এটা ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীর মনমানসিকতা, অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে। কেউ যেমন বিএনপি-জামায়াতের শাসনকে জ্বলন্ত আগুন ভাবছেন, তেমনি আরেকজন হয়তো ভাবছেন আওয়ামী লুটপাট, গুম, খুনের শাসনকেই সেটা। কার ভাবনা সঠিক? এর উত্তর আসলে কেউ দিতে পারবে না, দিতে পারার দরকার নেই।

গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এই প্রশ্নের উত্তর একটা মুক্ত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। তাই আমাদের যার কাছে যেটাই উনুন আর কড়াই মনে হোক না কেন, আমাদের সবার একমত হওয়া উচিত একটা ব্যাপারে যে এই সিদ্ধান্তটা ভোটের ময়দানেই হোক। জনগণের অধিকাংশ যদি ফুটন্ত কড়াই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে ফুটন্ত কড়াইয়েই আমরা ভাজা ভাজা হতে থাকি আরও কয়েক বছর। আর যদি বেশির ভাগ মনে করে নাহ্‌, ফুটন্ত কড়াইয়ে অনেক হয়েছে, এবার আমরা সবাই জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দিয়ে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাব। তাহলে সেই আপাত ‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্তে কে বাধা দিতে পারে এই গণতান্ত্রিক অবস্থায়?

আমরা যেহেতু দাবি করি যে আমরা একটা সভ্য সমাজে বাস করি, তাহলে এই সমাজে বসবাসের কিছুটা মূল্য আমাকে দিতেই হবে। সেটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া; সে হাইকোর্ট হোক আর নির্বাচন হোক, সেটির ফলাফল মেনে নেওয়া। বিচারপ্রক্রিয়ায় গলদ থাকলে সেটি নিয়ে অবশ্যই আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, আন্দোলন করতে পারি। নির্বাচনে অনিয়ম হলেও তা–ই।

কিন্তু যদি মনে করি বিচারপ্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবেই হয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তাহলে এর যেকোনো ফলাফল আমাকে মেনে নিতে হবে। তেমন এই নির্বাচন নিয়েও আমাদের সুধী, নাগরিক সমাজ কিংবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের একই দাবি হওয়া উচিত। সেটি হচ্ছে নির্বাচনকে যেকোনো মূল্যে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করতে হবে। শুধু তা–ই নয়, এর পরে এর ফলাফল যা–ই হোক না কেন, সেটি তাদের মেনে নেওয়ার মতো মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।

কিন্তু সেই মানসিক প্রস্তুতি এবং পরিপক্বতা দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সুধীজনদের একটা বড় অংশের মধ্যেই নেই বলে মনে হচ্ছে। তাঁদের অনেকেই আবার এই আওয়ামী শাসনামলে অর্থবিত্ত–ব্যবসা ইত্যাদি মিলিয়ে বেশ ভালোই ছিলেন। এই সব কারণ মিলিয়েই হয়তো নির্বাচন নিয়ে বিরোধীপক্ষের ওপর যে ব্যাপক দমন–পীড়ন চলছে, এটি নিয়ে তাঁরা তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করছেন না। আওয়ামী শাসন, যার কোনো বিকল্প নেই, সেটি ধরে রাখার জন্য বিরোধীপক্ষের ন্যূনতম রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক অধিকার দুমড়েমুচড়ে ফেলতে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই।

এর ভয়ংকর দিকটি হলো যে তাঁদের এই সুবিধাবাদী নৈতিকতা আসলে দেশের ইতিহাসে একটি ভয়াবহ উদাহরণ তৈরি করবে। তাঁরা যেভাবে সুযোগ বুঝে তাঁদের নৈতিকতার সুইচ অফ করে রেখেছেন, একইভাবে ভবিষ্যতে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও তার সমর্থক গোষ্ঠী একই কাজ করবে। তখন তাঁদের প্রতিবাদের জায়গাটা থাকবে কোথায়? কড়াই আর উনুনের আওয়াজ তুলে, আর আওয়ামী শাসনের বিকল্প নেই এই যুক্তি দিয়ে তাঁরা গণতন্ত্রচর্চার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটিকেই ধ্বংস হয়ে যাওয়াটাকে উপেক্ষা করতে রাজি আছেন। এখানেই লুকিয়ে আছে এখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় সংকট।

ড. রুশাদ ফরিদী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক
[email protected]