'ক্রীতদাস'রা কি স্বপ্ন দেখতে পারে?

সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলের তৃতীয় বছর ‘ক্রীতদাসের হাসি’ ছাপা হয়েছিল বিনা বাধায়। এটা বিস্ময়কর। দ্বিতীয় বিস্ময় ছিল আইয়ুব খানের জমানাতেই এর লেখক শওকত ওসমান জীবনের শ্রেষ্ঠ তিনটি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে তৃতীয় বিস্ময়টিই বোধ হয় বড়। গত ৫৭ বছরে ‘ক্রীতদাস’দের হাসি-কান্না নিয়ে তুলনাযোগ্য আর কোনো সাহিত্যকর্ম পেল না বাংলাভাষীরা।

শওকত ওসমান খলিফা হারুন রশিদের হাবসি গোলাম ও বান্দিদের বিপন্নতার কথা লিখেছিলেন। পরের প্রজন্মের দাস-দাসীদের জীবন ও মৃত্যুর ভাষ্য লেখার মতো আর কোনো শওকত ওসমানের জন্ম হচ্ছে না। পরবর্তী ‘খলিফা’দের জন্য বিষয়টা বিরাট স্বস্তির।

‘অ্যানিমেল ফার্ম’ ও ‘১৯৮৪’-এর বেলায়ও কি একই কথা বলা যায়? ইংরেজি জগতে জর্জ অরওয়েলের এই দুই সৃষ্টিকর্মের বয়স পেরোল যথাক্রমে ৭৩ ও ৬৯ বছর। দুনিয়াজুড়ে এগুলো আজও চিরপাঠ্য। অথচ পাশাপাশি আছে গুম, খুন, দমবন্ধ শাসন। নেই কেবল ওই রকম তীব্র ভাষাশিল্প। ‘নেপোলিয়ন’দের হাতে নিগৃহীত ‘বক্সার’ ও ‘ক্লোবার’দের কথা নতুন করে কে বলবে? কে লিখবে আজকের প্রজন্মের উইন্সটন স্মিথ-জুলিয়াদের বিচ্ছেদগাথা।

কর্তৃত্ববাদের ‘কওসুল্‌ আক্‌দার’
অরওয়েলের উইন্সটন স্মিথ ও জুলিয়া থাকত কর্তৃত্ববাদী ওশেনিয়ায়। বক্সার-বেঞ্জামিন-ক্লোবাররা থাকত ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এ। আর শওকত ওসমানের খলিফা হারুন থাকতেন বাগদাদের ‘কওসুল্‌ আক্‌দার’, তথা সবুজ প্রাসাদে। আজও বিশ্বের বহু বাগদাদে এ রকম প্রাসাদগুলোর উঁচু উঁচু দেয়ালের অপর পাশেই থাকছে গোলাম ‘তাতারী’ ও বাঁদি ‘মেহেরজান’রা। দৃশ্য ও দৃশ্যাতীত নানা খাঁচায় বন্দী তারা। নজরদারি সর্বত্র। একালের ওশেনিয়াগুলোতেও সরকার মানেই ‘বিগ ব্রাদার’। যেখানে সহিংসতাকে শান্তি, স্বাধীনতাকে অপরাধ এবং অজ্ঞতাকে শক্তি হিসেবে দেখানো হয়।

শওকত ওসমানের কল্পনার কওসুল্‌ আক্‌দার এ কারণে চিরায়ত যে সেদিনের খলিফাদের মতো আজকের খলিফাদের প্রাসাদেও কেবল জল্লাদ মশরুর নয়, রয়েছে অসংখ্য মোসাহেবও। দেয়ালের অন্যদিকের গোলাম ও বান্দিদের কান্না সহযোগীদের চাটুকারিতায় কোনো ব্যাঘাত ঘটায় না। জুলুম জায়েজ করার জন্য আবদুল কুদ্দুসদের ফতোয়াও মেলে সহজেই।

খলিফাতন্ত্রে রাষ্ট্রবাদী ‘থিংকট্যাংক’দের মগজে মুদ্রার প্রভাব কাজ করে চলে অবিরাম। প্রভুর সঙ্গে মিলে তারা কেবল খাঁচায় থাকা মানুষগুলোর কাছ থেকে হাসির ধ্বনি শুনতে চায়; কথা বলার স্বাধীনতা না দিয়েই! শওকত ওসমানের উপন্যাসে এই শাসক-মোসাহেবদের বলা হয়েছে ‘হাসির সওদাগর’। এই বর্ণনায় এসে শওকত ওসমানের খলিফা হারুনর রশিদ কেবল বাগদাদের শাসক থাকেন না এবং তাঁর সহযোগীরাও বেঁচে থাকে আইয়ুব খানসহ সব কর্তৃত্ববাদী শাসকের আশপাশে; গোলামদের বস্তিগুলো থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে।

‘খলিফা’দের সহযোগীরা দুনিয়াজুড়েই কেবল সমর্থন চায়। ওশেনিয়ার ‘মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ’ এবং ‘চিন্তা পুলিশ’ও প্রতিনিয়ত ‘বিগ ব্রাদার’-এর জন্য সমর্থন তৈরি করে চলে উইন্সটন ও জুলিয়াদের মননে। বন্দীদের নিত্য হাসি ও পুনঃপুন সম্মতি ছাড়া কর্তৃত্ববাদের ঘুম আসে না। এ বড় অদ্ভুত রোগ। কিন্তু ‘সমর্থন’ যে বহু উপাদানে তৈরি হয়, সেটা তারা বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না। খাঁচার পাখিকে কেবল খাবার দিলেই সে গান গাইতে শুরু করে নাÑবরং আরও জোরে মুক্ত হতে চায়। এভাবে প্রতিনিয়ত তারা ক্ষতবিক্ষত হয়। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোতে তাই প্রতিটি আত্মা বিপন্নতায় বাঁচে।

রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতাহীন রাষ্ট্রে শাসকেরা মূলত নাগরিকের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়; তাদের মধ্যে সর্বগ্রাসী এক হীনম্মন্যতা ও অপরাধের বোধ তৈরি করে। এভাবে নাগরিকসমাজ তার সব ইতিবাচক স্মৃতি হারিয়ে বর্তমানের ভেতর ভয়ে সেঁটে থাকে। সৃজনশীলতার মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে। তার সামনে হাজির করা হয় উন্নয়ন উচ্ছিষ্টের লোভের দরিয়া। ছাড় দিতে হয় কেবল নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার।

কর্তৃত্ববাদে নাগরিককে একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তাও করতে হয় শাসকদের সাজানো ছকে। প্রত্যেক কর্তৃত্ববাদ তাই সব সময় নতুন প্রজন্মকে ‘নতুনভাবে গড়ে ওঠা’র কথা বলে। এটা তাদের এক পরিচিত আহ্বান। আসলে তারা যা গড়তে চায়, তা হলো প্রশ্ন ভুলে যাওয়া ‘সমর্থক’গোষ্ঠী। এরূপ সমর্থকদের মধ্যে কোনোরূপ সৃজনমন দেখতে চায় না খলিফা হারুন, ‘নেপোলিয়ন’ বা ‘বিগ ব্রাদার’রা। প্রায় সব ‘কওসুল্‌ আক্‌দার’ সৃজনশীলতাকে হুমকি জ্ঞান করে। কারণ, তাতে দুর্গ রক্ষায় ঝুঁকি বাড়ে।

ক্রীতদাসরা কি উঠে দাঁড়াতে সক্ষম?
শওকত ওসমানের ‘জাহাকুল আবদ্’-এ ‘অ্যানিমেল ফার্ম’–এর মতো মুক্তির প্রতীক কোনো ‘স্নোবল’ বা ‘ওল্ড মেজর’ নেই। নেই ‘১৯৮৪’-এর উইন্সটনের মতো কোনো বিদ্রোহী চৈতন্য। তবে অরওয়েলের সৃষ্টির সঙ্গে তুলনায় ‘ক্রীতদাসের হাসি’র দারুণ এক অনন্যতা নজরে আসে। ৫৭ বছর পরও শওকত ওসমানের সৃষ্টি সমকালীন এক সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে যে কর্তৃত্ববাদ বাইরে থেকে কঠোর ও অজেয় মনে হলেও অন্তর্গতভাবে তা নাজুক। তার পেছনে থাকে না স্বতঃস্ফূর্ত জনসম্মতি। তাই বোধ হয় ‘ক্রীতদাসের হাসি’ প্রকাশের আট বছরের মাথায় জন-আন্দোলনের মুখেই পাঁচ তারকা জেনারেল আইয়ুব খানকে বিদায় নিতে হয়। কিন্তু তারপরও নতুন অবয়বে আইয়ুব খানদের আগমন থামানো যায়নি। বরং কর্তৃত্ববাদকে ঊর্ধ্বমুখীই দেখা যায়। সবাই একে নিকৃষ্টই বলছে, কিন্তু এর মায়াজাল কাটছে না।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ফ্রিডম হাউস’-এর প্রতিবেদনে (ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৮) দেখা যায়, ২০১৭ থেকে পূর্ববর্তী এক যুগে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতার অবনতি ঘটছে। সব মিলে ১১৩টি দেশে এর অবনতি ঘটেছে। উল্টোটি ঘটেছে কেবল ৬২ দেশে।

অর্থাৎ কর্তৃত্ববাদী শাসন এখনো কোনো অতীতের ব্যাপার নয়; বরং তা প্রবলভাবে বর্তমানে উপস্থিত। খুবই সতেজ তার অগ্রযাত্রা। জুলুম আড়াল করতে ফ্যাসিবাদের পক্ষে নানান প্রোপাগান্ডায় ভাসছে দুনিয়ার অনেক দেশ। দীর্ঘ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত অনেক দেশেও দীর্ঘস্থায়ী গোষ্ঠীতন্ত্র জেঁকে বসছে।

কিন্তু কেন এমন হয়? কীভাবে এটা ঘটতে পারে? কীভাবে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাওয়া জনতাকেও নতুন নতুন ‘ত্রাণকর্তা’ ধোঁকা দিতে পারে? কীভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশাসনকে ‘বলার স্বাধীনতা’র বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায়? প্রশ্নহীন আনুগত্যকে কীভাবে রাষ্ট্রবান্ধব ব্যাপার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়?

এসব দীর্ঘশ্বাসের প্রধান এক উত্তর হলো, যখন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থাকে বা দুর্বল করে রাখা হয় বা সবল করার কাজ আড়াল করে রাখা হয়, তখনই কর্তৃত্ববাদ নির্বিঘ্নে পাখা মেলতে পারে। যেখানে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সবল, সেখানে কর্তৃত্ববাদ প্রথমে তা বিধ্বস্ত করে। আর সেটা তখনই সম্ভব হয়, যখন জনগণকে দিগ্‌ভ্রান্ত করা যায়; বিভক্ত করা যায়। এই বিভক্ত করার কাজটি করা হয় কোনো ভুল বিশ্বাসে জনতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও আসক্ত করে।

কর্তৃত্ববাদ সব সময় উচ্চমাত্রার কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে যাত্রা করে। অধিকতর সামাজিক ন্যায়বিচার ও অধিকতর গণতন্ত্রের নতুন প্রকল্প নিয়ে সমাজে নামে তারা। জনতাকে বিভক্ত করতে ইতিহাসের বিকৃত ও একপেশে বয়ানকেও হাজির করা হয়। ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে অরওয়েল তার চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন।

জনগণকে বিভক্ত করে যত দিন পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে, তত দিনই কর্তৃত্ববাদের স্বর্ণযুগ থাকে। কর্তৃত্ববাদ মানেই তাই বিভেদের পক্ষে সর্বগ্রাসী প্রোপাগান্ডা। কর্তৃত্ববাদ ধর্ম বা জাতিগত বা ঐতিহাসিক শ্রেষ্ঠত্বের এমন এক মোহে জনতার একাংশের মনে ঘোর লাগায় যেন তাদের মধ্যে ‘অপর’কে ঘৃণা করার নিকৃষ্ট প্রবৃত্তিগুলো জেগে ওঠে।

গোলামদের আত্মার জাগরণ প্রয়োজন
শান্তিপূর্ণ দৃশ্যের মধ্য দিয়েও কর্তৃত্ববাদ কায়েম হতে পারে। তবে সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না। সে কারণে কর্তৃত্ববাদকেও শেষমেশ সহিংস হতেই হয়। খুন-জখম ছাড়া এটা টিকে থাকতে পারে না। কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে সহিংসতার সম্পর্ক তাই অবিচ্ছেদ্য, আদিম।

গণতান্ত্রিক অধিকারবোধের পক্ষে নাগরিক চৈতন্যের জাগরণ ছাড়া এই সহিংসতাকে প্রতিরোধ করা যায় না। এর কোনো সংক্ষিপ্ত-সমতল পথ নেই। তাই ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ কিংবা ‘১৯৮৪’ কোনো আশাবাদ দিয়ে শেষ হয় না। গোলামদের মানবিক মহব্বতের বিপরীতে দাঁড়ানো মনিবেরই জয় হয় সেখানে।

ক্রীতদাসদের উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্ন অনেকখানি নির্ভর করে তারা কত সংখ্যায় এবংÑকী মাত্রায় মনিবদের বিভেদবাদী প্রোপাগান্ডা শনাক্ত করতে পারছে। এটাই মুক্তির প্রথম পাটাতন, যার ওপর দাঁড়ায় প্রতিরোধী চেতনার ঐক্য। তখনই কেবল ক্রীতদাসদের আত্মা হাসতে ও ভালোবাসতে সক্ষম হয়। শওকত ওসমানের গোলাম তাতারী প্রতিপক্ষকে শেষ দৃশ্যে সেটাই শোনায়: দৌলত দিয়ে গোলাম কেনা যায় কিন্তু হাসি নয়! তবে দৌলতের রাজত্ব অতিক্রম করতে প্রয়োজন গোলামদের আত্মার জাগরণ।

প্রয়োজন ইন্তিফাদা।

আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস গবেষক