এই ভুলের দায় কার?

আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুল

আগামী নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে উচ্চ আদালতের কিছু নির্দেশনায় নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির ১৭ জন প্রার্থীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার স্থগিত হয়েছে। এসব আসনে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের কেউ না থাকায় নির্বাচনে একতরফা সুবিধা পাবে সরকারি দল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যে দুজন প্রার্থীর প্রার্থিতা স্থগিত করা হয়েছে, তাঁরা দুজনই বিদ্রোহী প্রার্থী বলে এর সুবিধা পাবে দলটি।

নির্বাচন কমিশন প্রার্থিতা চূড়ান্ত ও প্রতীক বরাদ্দ করার পর উচ্চ আদালত কর্তৃক এত ব্যাপকভাবে প্রার্থিতা স্থগিতের ঘটনা আগে ঘটেনি। আগের নির্বাচনগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বরং আগেই বাতিলকৃত প্রার্থীরা তাঁদের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।

উচ্চ আদালতের এবারের নির্দেশনাগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে বিএনপির মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের কোনো কোনো নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্ন তোলার মধ্যে রাজনীতি থাকতে পারে। তবে আইনগতভাবেও এসব নির্দেশনা নিয়ে কিছু প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।

প্রথম প্রশ্ন উচ্চ আদালতের এখতিয়ারের সীমানা নিয়ে। আমরা জানি অন্য কোনো আইনে সমফলপ্রদ প্রতিকার না থাকলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ রয়েছে সংবিধানের ১০২ (২) অনুসারে। তবে তারপরও উচ্চ আদালত ‘ডকট্রিন অব পলিটিক্যাল কোয়েশ্চেন’ অনুসারে রাজনৈতিক বিষয়াবলিতে সাধারণত সংশ্লিষ্ট হয় না। এ ছাড়া সর্বোচ্চ আদালতে (যেমন সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন) ইতিমধ্যে কোনো বিষয়ে আইনগত ব্যাখ্যা দেওয়া হলে তার পরিপন্থী কিছু পরবর্তী সময়ে করা হয় না। আপিলেট ডিভিশনের একাধিক রায়ে (যেমন ৬২ ডিএলআর ৪২৫,২০১০) নির্বাচনকালে নির্বাচনী বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলা আছে। আবার ২০১১ সালের সংবিধান সংশোধনীতে তফসিলের পর আদালত কোনো নির্দেশ দিলে নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ দিতে বলা হয়েছে।

উচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক রুলগুলো ছিল অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ। অর্থাৎ এসব আদেশ চূড়ান্ত করার আগে কমিশনকে জবাব দেওয়ার ও যুক্তিসংগত শুনানির সুযোগ দেওয়া হবে। সংগত কারণেই এই সম্ভাবনা রয়েছে যে শুনানির পর স্থগিতকৃত প্রার্থীরা তাঁদের প্রার্থিতা ফেরত পেতে পারেন। কিন্তু সেটি নির্বাচনের আগে হওয়ার সময় আর নেই বলা যায়। সে ক্ষেত্রে তাঁদেরকে এখনই বাদ দিয়ে নির্বাচন করা হলে শুধু তাঁদের নির্বাচন করার সম্ভাব্য অধিকারই ক্ষুণ্ন হবে না, বিপুলসংখ্যক ভোটারের প্রতিনিধি পছন্দ করার সুযোগও সংকুচিত হয়ে যাবে।

উচ্চ আদালতে বিএনপির প্রার্থীদের প্রার্থিতা স্থগিত হয়েছে যেসব কারণে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ৯ জন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বিষয়টি। উপজেলা পরিষদ আইনে তাঁদের নির্বাচন করার সুযোগ রয়েছে। তবে উপজেলা পরিষদ আইনের ৮ (২) ধারায় বলা আছে যে তাঁরা লাভজনক পদে সার্বক্ষণিক অধিষ্ঠিত হলে বা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে আর চেয়ারম্যান পদে থাকতে পারবেন না। এর মানে এটাই যে চেয়ারম্যান পদটি লাভজনক পদ নয় এবং তাঁরা সংসদ নির্বাচন করতে অযোগ্য নন।

জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশেও (আরপিও) তাঁদের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। আরপিওর ১২ (১) (গ) অনুসারে সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের কারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিন্তু উপজেলা পরিষদ (৫ ধারা) বা পৌরসভা সংশ্লিষ্ট আইন (৪) অনুসারে এগুলো সে রকম কোনো কর্তৃপক্ষÿনয়, এগুলো সেখানে বর্ণিত আছে বডি করপোরেট বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা মেয়র সমমর্যাদার ও সমপ্রকৃতির স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি। হাইকোর্টের একটি রায়ে (৬৫ ডিএলআর ৩৮৭) পৌরসভা মেয়র লাভজনক পদ নয় বলে স্পষ্টভাবে উল্লেখও করা আছে। গত সংসদ নির্বাচনে অনেক স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন এবং তাঁদের অন্তত চারজন (যেমন তৎকালীন ফেনী ও চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র) নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন।

এসব বিধান ও নজির থাকার পর একজন উপজেলা চেয়ারম্যান পদত্যাগ করলেন কি না, বা তা সময়মতো গৃহীত হলো কি না, সেটি সংসদ নির্বাচনে তাঁর অংশগ্রহণের অন্তরায় কীভাবে হয়, তা স্পষ্ট নয়।
চূড়ান্ত শুনানিকালে এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কমিশনের থাকবে। উচ্চ আদালতে স্থগিতকৃত অন্য যেসব প্রার্থীকে নির্বাচন কমিশন যোগ্য প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছিল, তার পক্ষেও নিশ্চয়ই কমিশনের যুক্তি ছিল। এসব কথা আদালতে জোরলোভাবে তুলে ধরার দায়দায়িত্ব কমিশনের রয়েছে।

আরেকটি কথা। উচ্চ আদালতে প্রার্থিতা স্থগিত হওয়ার কোনো আইনি কারণ থাকলে তাদের কমিশন কর্তৃকই বাতিল করা উচিত ছিল। কমিশন সেটি না করে কোনো ভুল করে থাকলে তার খেসারত কেন একটি রাজনৈতিক দল, তার প্রার্থী ও তার সম্ভাব্য ভোটারদের দিতে হবে? আর যদি কমিশনের কোনো ভুল না থাকে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে তাঁদের কেন বঞ্চিত হতে হবে?

বিএনপি উচ্চ আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রার্থিতা যেসব আসনে স্থগিত হয়েছে, সেখানে নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানিয়েছে। কমিশন এটি নাকচ করেছে। তবে এখানে পুনর্বিবেচনার সুযোগ এখনো আছে।

আইনি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বৃহত্তর জনস্বার্থকে বিবেচনা করতে হয়। সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। এই নির্বাচনে বেশি প্রার্থী দাঁড়ানোর সুযোগ পেলে এবং ভোটারদের পছন্দের সুযোগ বেশি থাকলে সেটি বৃহত্তর জনস্বার্থের অনুকূল হয়।

*লেখাটিতে প্রকাশিত বক্তব্য লেখকের নিজস্ব

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাবি