ঝালকাঠি-২; জেতাবে নলছিটি!

জেবা খানের নাম উঠতেই এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা করম আলী চায়ের কাপ থেকে মুখ সরিয়ে ঠোঁটটা জিব দিয়ে পরিষ্কার করে বলেন, ‘রাজাকারের মেয়ে।’ দুজন প্রায় চিৎকার করে একসঙ্গে বলেন, ‘গুজব। কী পেরমান আচে?’ ঝালকাঠি–২ আসন সরেজমিন দেখে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা

নিন্দুকেরা নলছিটি সম্পর্কে বলেন, ‘তাগো কাছে মার্কা কোনো ম্যাটার না। দ্যাশের মনু পাইলে কোনো কথা নাই।’ বয়স হয়তো ৮০ হবে, বলেন ৯০। দাবি করেন, হক সাহেবের ভোট দেখেছেন, মানে ৫৪–র নির্বাচন দেখেছেন। নাম সুরুজ তালুকদার। পড়েছেন নলছিটি মার্চেন্ট হাইস্কুলে। জানতে চান, এমন স্কুলের নাম শুনেছি কি না? ‘প্রাইভেট সেক্টর সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি না কী যেন কয়, সিএসআর না করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি, হেইডা ১৯২৯ সালে এহানে ঘটেছে।’ নিজেই ব্যাখ্যা করেন, ‘বর্তমান বরিশালের পূর্ব নাম ছিল বাকেরগঞ্জ জেলা আর এ বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা সদর দপ্তর ছিল নলছিটি উপজেলায় বারৈকরণ গ্রাম। হেই ইতিহাস ধরলে মোরাই আসল বরিশাল। এইহানে হাইস্কুল হইসে ব্যবসায়ীদের চাঁদায়।’ বেশির ভাগ বণিক ব্যবসায়ী ছিলেন পরদেশি। এখনো এক চীনা বণিকের কবর আছে নলছিটি বন্দরের পৌরসভার কাছে। ‘পুরান বাজার ঘুরে আইসেন না, জানেন তাঁর অরিজিনাল নাম? ওটা ছিল আমাদের চায়নিজ মার্কেট। বাপ–দাদারা বলত চীনা বাজার।’ নলছিটির শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান আর শেষ হয় না।

অঙ্কের হিসাবে পৌরসভাসহ ঝালকাঠি সদর উপজেলার লোকসংখ্যা এবং ভোটারসংখ্যা নলছিটির চেয়ে কম। তবে এত কম নয় যে নলছিটি একাই ফলাফল ঠিক করে দিতে পারে। সব দলেরই সমর্থক আছে সব উপজেলায়। তারপরও নলছিটির মানুষের এককাট্টা হওয়ার ইতিহাস আছে। সেই জোরেই নাকি মরহুম জুলফিকার আলীর বিধবা স্ত্রী ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো দু–দুবার এই আসনে বড় প্রার্থীর (আমির হোসেন আমু) বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। একবার উপনির্বাচনে (২০০০ সালে), তারপর আবার ২০০১–এর জাতীয় নির্বাচনে। প্রবীণ তালুকদারের পাশে দু-একজন করে মানুষ দাঁড়িয়ে কথা শুনতে শুনতে ঢুকে পড়ে আলোচনায়। ‘ইলেন ইবার নাই’, ‘২০০৮ হারছে’, ‘এলাকায় দেহা যায় না’ ইত্যাদি। তালুকদারের কণ্ঠ ক্রমে চাপা পড়তে থাকে মজা দেখতে জমে যাওয়া আমজনতার টীকা–টিপ্পনীতে। ভিড়ের ভেতর থেকে কে একজন গলা উঁচিয়ে বড়াই করেন, ‘আমরাই পেরথম নারী সংসদ সদস্য বানাইছি।’ তালুকদার নিচু কণ্ঠে বলেন, ‘বলদ।’

কথাটা হয়তো ঝালকাঠি জেলার জন্য ঠিক, কিন্তু সরাসরি সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০০ সালের অনেক আগে এ দেশে নারী সংসদ নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড আছে। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ ভোটে খুলনা-১৪ থেকে সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশে সেটাই প্রথম।

এবার প্রথমে ইলেন ভুট্টোর নাম শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত ঝালকাঠি–২ আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য জেবা আমিনা (আহমেদ) খান। নৌকা ও ধানের শীষ ছাড়াও এই আসনে আম, লাঙ্গল, হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন যথাক্রমে জাহাঙ্গীর হোসেন, কুদ্দুস খান ও মুফতি সৈয়দ মো. ফয়জুল করীম। জেবা খানের নাম উঠতেই এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা করম আলী চায়ের কাপ থেকে মুখ সরিয়ে ঠোঁটটা জিব দিয়ে পরিষ্কার করে বলেন, ‘রাজাকারের মেয়ে।’ দুজন প্রায় চিৎকার করে একসঙ্গে বলেন, ‘গুজব। কী পেরমান আচে?’

জমাট বাধা ভিড় চটজলদি যেন দুভাগ হয়ে যায়। কারও কথা স্পষ্ট কানে আসে না। সুরুজ তালুকদার জোরে এক খ্যাঁকানি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন, যেন ইঙ্গিত দিলেন তাঁর কথা শোনার জন্য। বিএ পাস তালুকদার ভিড়ের সবার চেয়ে বেশি জানেন—সেই বোধ থেকে সবাই গলা নামিয়ে ফেলে। ‘আক্তার ব্যারিস্টারের বেটি—হবে।’ ভিড়ের কেউ কখনো এই ব্যারিস্টারের নাম শুনেছে বলে মনে হলো না। এবার করম আলী সবাইকে জানিয়ে দেন, যুদ্ধের বছরে মালেক গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের অসামরিক সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন আক্তার ব্যারিস্টার। তিন মাসের মাথায় ঢাকা মুক্ত হলে তাঁদের ঠাঁই হয় জেলহাজতে।

বাহাস শুরু হয় করম আলী আর তালুকদারের মধ্যে। বরিশাল অঞ্চলের একসময় জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি ছিলেন ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন আহমদ। আইয়ুব খানের সময় পাকিস্তানের পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। তার আগে হক সাহেবের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাতে কী, ৭১–এ পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল, আর কী প্রমাণ চান? হক সাহেবের ছেলেকে শেখ সাহেব ৭০–এর নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে এমএনএ বানিয়েছিলেন। তিনিও সুযোগ পেয়েও যুদ্ধে শরিক হননি। পশ্চিম পাকিস্তানের লায়ালপুরে পুরা নয় মাস ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হলে নানা দলের স্বাদ চেখে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী ঘরে ফেরত এসে মন্ত্রী হয়েছেন। আমার সঙ্গে থাকলে তুমি তুলসী, না থাকলে বিছুটিপাতা। বাহাসের সুর চড়তে থাকে। একটা মিছিলের আওয়াজ দূর থেকে ক্রমে যেন কাছে এগিয়ে আসে। পরিষ্কার হয় আওয়াজ—‘সব নেতা দেখা শেষ, ‘সব মার্কা দেখা শেষ, হাতপাখার বাংলাদেশ’। বাহাস পেরিয়ে হাতপাখা চলে যায়। তালপাতার হাতপাখা। সরকার বজ্রপাত থেকে দেশকে রক্ষা জন্য রাস্তার ধারে তালগাছ লাগানোর কর্মসূচি নিয়েছে। ভবিষ্যতে নিশ্চয় অনেক তালপাতার হাতপাখা পয়দা হবে।

নলছিটি আর ঝালকাঠি সদর নিয়ে ঝালকাঠি–২ আসন। ঝালকাঠি জেলার দুটি আসনের মধ্যে এই আসন সেসব সংসদীয় আসনের একটি, যেখানে ২০১৪ সালে কোনো নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীহীন নির্ঝঞ্ঝাটের সেই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার এই আসনে থেকে যান আমির হোসেন আমু। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই আসনে তিনি মোট চারবার প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে একবার ছিল উপনির্বাচন। চারবার চেষ্টা করে জিতেছেন একবার। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে এই আসনে নির্বাচিত হন বিএনপি প্রার্থী গাজী আজিজ ফেরদৌস। সেবার বর্তমান এমপি এবং মন্ত্রী আমির হোসেন ছিলেন তৃতীয় স্থানে। ১৯৯৬–এর নির্বাচনে তিনি ঝালকাঠি–২–এর বদলে ঝালকাঠি–১ আসনে নির্বাচন করে আবারও তৃতীয় হন। ১৯৯৬ সালে ঝালকাঠি–২ আসনে নির্বাচিত হন নলছিটির বাসিন্দা জাতীয় পার্টির জুলফিকার আলী। অনেকের ধারণা, এই আসনে দিনের শেষে হার–জিতের হিসাব কষে দেন নলছিটির ভোটাররা।

গওহার নঈম ওয়ারা: শিক্ষক ও গবেষক