'আমাদের একটা প্ল্যাটফর্ম চাই'

আমরা বলছি বটে যে এবারের নির্বাচনে তরুণদের ভোট যেদিকে যাবে, জিতবে ওরাই। প্রায় সব দলের ইশতেহারে তরুণদের জন্য বেশ কিছু অধ্যায়ও রাখা হয়েছে। কিন্তু নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছে তরুণেরা যে কী চান, সেটা জানার চেষ্টা করছে কটি দল? আসলে তরুণদের চাওয়া-পাওয়ার কথাগুলো ঠিক করে দিয়েছেন বড়রা। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের মূল নেতারা। আর সেখানেই তরুণদের বেশ আপত্তি।

তরুণেরা বলছেন, ‘দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে যে আমাদের কথা পৌঁছে দেব, তার প্ল্যাটফর্ম কোথায়? নতুন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরতে চাই। কিন্তু সুযোগ তো পাই না।’ কয়েকজন তরুণী বললেন, ‘আমরা “নারী” না, “মানুষ”। মানুষ হিসেবে সমাজে আমাদের স্বীকৃতি চাই। বাসে ওঠা যায় না। ভিড়ের মধ্যে হেনস্তা হতে হয়। তাহলে চলাফেরা করব কীভাবে? দেখুন, মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?’

আরেকজন বললেন, ‘টয়লেটের অভাবে আমরা সারা দিনে পানি পান করতে ভয় পাই।’ একজন বললেন, ‘গ্রাম থেকে এসেছি বড় শহরে চাকরি করতে। আমরা কোথায় থাকব?’ এই রাজধানীতে কর্মজীবীদের জন্য কয়টা নিরাপদ হোস্টেল আছে? নারীর ক্ষমতায়নের কথা যতই বলা হোক না কেন, তাঁদের যদি নিশ্চিন্তে থাকার ভালো জায়গা না থাকে, তাহলে ক্ষমতায়ন কি কারও দয়ায় আসবে?

মনে হবে খুব সাধারণ কথা। কিন্তু গুরুত্ব অনেক বেশি। রাজনৈতিক দলের ইশতেহারগুলোতে সাদামাটাভাবে এসব কথা আছে। কিন্তু কতটা গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে? অথচ তরুণদের চিন্তায় এটা বেশ গুরুত্ব পেয়েছে।

নতুন সরকারের কাছে তরুণদের প্রত্যাশা নিয়ে ২৫ ডিসেম্বর প্রথম আলো এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সহযোগিতায় ছিল ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইডি) ও বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। ঢাকা থেকে শুধু নয়; সুদূর দিনাজপুর, খুলনা, বরিশালসহ আরও বেশ কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তরুণেরা যোগ দেন। খোলামেলা কথা বলেন।

তাঁরা রাজনীতির কথা বলেছেন। বলেছেন, নির্বাচিত নতুন সরকারের কাছে তাঁরা চাইবেন যেন সংসদে বিরোধী দলকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয়। যেন হিংসা, হানাহানি না থাকে। হরতাল-হামলা-মামলা যেন বন্ধ হয়। সব দলের লক্ষ্য যেন হয় দেশের উন্নয়ন এবং মানুষের কল্যাণ। ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন তরুণেরা।

তরুণেরা তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবনের নিশ্চয়তা চান। চাকরি-বাকরি, মানসম্পন্ন পেশায় দক্ষতা অর্জনের পর্যাপ্ত সুযোগ প্রভৃতি নিয়ে সব সময় তাঁদের উদ্বেগ। তরুণেরা যেন উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ পান। যেন কর্মসংস্থানের জন্য চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকে। চাকরির বাজার সীমিত। তাই নিজে যেন একটা কিছু কাজ শুরু করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা চান তরুণেরা। আর সবচেয়ে বড় কথা, তরুণদের এমনভাবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যেন ১০ থেকে ২০ বছর পরে তাঁরা চাকরির বাজারে বেকার হয়ে না পড়েন।

কথাটা গুছিয়ে বললে দাঁড়ায় এ রকম: রোবট আসছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) আসছে। তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ অফিস সহকারীর কাজ, হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাজের লোকের প্রয়োজন হয়তো তেমন থাকবে না। তাই আগামী দিনের সরকারকে দৃষ্টি রাখতে হবে একটু সামনের দিকে। তরুণদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণও হতে হবে একটু অগ্রসরমুখী। যাঁরা বিদেশে চাকরির জন্য যাচ্ছেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন, তাঁদের কথা চিন্তা করছেন আজকের তরুণেরা। তাঁরা বলছেন, আমাদের দেশের কর্মীরা বিদেশে কেন শুধু গায়ে খাটার কাজ করবেন? তাঁদের এখন থেকেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী করে তুলতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে শুধু লিখতে-পড়তে জানাই (লিটারেসি) যথেষ্ট নয়। তরুণদের নিউমারেসি ও কম্পিউটার লিটারেসিতে দক্ষ হতে হবে।

এ জন্যই তরুণদের প্রত্যাশা, নতুন সরকার এসে যেন তাঁদের পরিকল্পনার কর্মকৌশলে মৌলিক পরিবর্তন সাধন করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের কথা মনে রেখে নতুন যুগের উপযুক্ত নতুন মানবসম্পদ তৈরিই হতে হবে আগামী দিনের সরকারের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।

আমাদের উচ্চশিক্ষার দুর্গতির একটি কারণ হলো এখানে মানসম্পন্ন গবেষণার সুযোগ সীমিত। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বাজেটে যেন বেশি বরাদ্দ রাখা হয়, এর ওপর তরুণেরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। আমাদের তরুণ গবেষকদের গবেষণাপত্র যখন আরও বেশি সংখ্যায় বিশ্বের সেরা জার্নালগুলোয় প্রকাশিত হবে, তখন আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারব যে আমাদের তরুণেরা বিশ্বমানের শিক্ষায় সামনের সারিতে স্থান করে নিচ্ছেন।

প্রবাসী তরুণেরা অবশ্য এখনই যুক্তরাষ্ট্রের নাসা, গুগল, ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উঁচু পদে নিয়োজিত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন টেকনোলজি, ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনসসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন। এখন দেশেই সেই উঁচু মানের গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের কথা তরুণেরা বলেছেন। এই সামাজিক দুষ্ট গ্রহ থেকে বেরিয়ে আসার কার্যকর কর্মসূচি কোথায়? নতুন সরকারকে এ কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সরকারের দায়িত্ব তো আছেই; পাশাপাশি দায়িত্ব অনেকাংশে পরিবারেরও। সেখান থেকেই কাজটা শুরু করতে হবে।

একজন তরুণ একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেন। একটি অশুভ চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। তারা তো নিশ্চয়ই মূল অপরাধী। তাদের আইনের আওতায় অবশ্যই আনতে হবে। কিন্তু আমরা কেন সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন হাজার হাজার টাকায় কেনার জন্য ছুটছি? আমাদের বাবা-মা কেন বাধা দেন না? ঘরে ঘরে এই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় সমূলে উচ্ছেদ করার দায়িত্ব সবার।

তরুণদের দৃষ্টি কিন্তু বেশ প্রসারিত। তাঁরা টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) কথাও বলছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, স্বাস্থ্য-পুষ্টি, দারিদ্র্য হ্রাস থেকে শুরু করে প্রতিটি নাগরিকের জীবনধারায় উন্নয়নের ছোঁয়া আনতে হবে। কথাটা এসেছে এভাবে: শুধু নগর উন্নয়ন হলে চলবে না; গ্রামের মানুষও যেন উন্নত জীবনযাপন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়নের গোড়ার কথা। এটা নগরের ওপর চাপ কমানোর জন্য যেমন, তেমনি আবার আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্যও দরকার। কৃষির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রামের মানুষ যেন আধুনিক বিধিব্যবস্থা, সুযোগ-সুবিধা পায়। কৃষির আধুনিকায়ন এখন হচ্ছে। এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

তরুণেরা বিশেষভাবে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কথা মনে রেখে আমাদের দেশের যাবতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। বিশ্বপরিসরে সবাই জানে বাঙালি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমাদের আরও নতুন নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। আগামী দিনের নতুন সরকার যদি তারুণ্যের এই ইশতেহারের কথাগুলো নীতিনির্ধারণে প্রাধান্য দেয়, তাহলে দেশ অগ্রগতির পথে খুব দ্রুত এগিয়ে যাবে। এটাই তরুণদের প্রত্যাশা।

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail. com