অনিবার্য শেখ হাসিনার যত দায়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছয় বছরের মাথায় মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের মতো বিশাল এক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা, অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রেই বলা যায়। রাজনৈতিক পরিবারে তাঁর জন্ম, বেড়েও উঠেছেন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে, জড়িত ছিলেন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও। ভারত বিভাগের অব্যবহিত পরেই, ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি যখন জন্ম নেন, সময়ের হিসাবে ঠিক তখনই বাংলার মানুষের মনে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। বস্তুত শেখ হাসিনার আত্মজীবনী এবং বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস—এক ও অভিন্ন। ধর্মভীরুতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং সাংস্কৃতিক চেতনা—সব মিলিয়ে তিনিই বাংলার মুখ। তিনি শুধু জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকার নন, আদর্শের উত্তরাধিকারও বটে। সব বিবেচনাতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের একজন ‘প্রডিজি’। তবে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে তাঁকে পুড়ে পুড়ে রীতিমতো খাঁটি সোনা হতে হয়েছে। নির্মম সে ঘটনায়, জাতির প্রতি, ঘুরে দাঁড়াতে না পারার অভিমানও তাঁর কেটেছে অনেকটা সময় নিয়েই।

১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার পাশাপাশি প্রতিটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি নিজেকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করেন। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও হয়ে ওঠে তাঁর আরেকটি সমান্তরাল ফ্রন্ট। আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উসকে ওঠা অতি বাম ও অতি ডান প্রবণতার বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন একমাত্র রক্ষাকবচ। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে তাঁর ব্যক্তিগত নিখাদ ধর্মপরায়ণতা আওয়ামী লীগকে ধর্ম ব্যবসায়ীদের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে আসছে বারবারই। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক নিজেকে এবং দলকে অভিযোজিত করে চলেছেন। পথপরিক্রমার বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক বড় বড় নেতা আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যান, দলে ভাঙনও আসে, কিন্তু আওয়ামী লীগ তাতে দুর্বল না হয়ে বরং আরও সংহত হতে থাকে।

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই, ১৯৯১ সালে, ১০ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে দলকে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে শেষমেশ আর পেরে ওঠেননি। কিন্তু হতোদ্যম না হয়ে খালেদা জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফেরত গিয়েই তিনি আবার গণতন্ত্র উদ্ধার এবং নিজেকে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করে তোলার সংগ্রাম শুরু করেন। মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের পতন ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐকমত্যের সরকার গঠন করেন বঙ্গবন্ধুর তনয়া। সে সময় ক্ষীণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও দক্ষিণপন্থী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভিত তখনো শেখ হাসিনাকে এতটুকু দুর্বল করতে পারেনি। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছায়ায় তারা আবারও জনগণের রায় ছিনিয়ে নিয়ে যায়। থমকে না গিয়ে আবার তিনি নতুন উদ্যমে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ২০০৬ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে নিশ্চিত বিজয়ের দুয়ারে নিয়ে যান। কিন্তু সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র তখন তাদের মার্কিন মদদপুষ্ট ‘সুশীল’দের সঙ্গে নিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। কিন্তু সেনা–সমর্থিত ‘সুশীল সরকার’ মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনাকে শত দমন–নিপীড়নেও দাবিয়ে রাখতে পারেনি।

২০০৮ সালের ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন, তিনি তখন অনেক পরিণত একজন মানুষ। ১০ মাসের কারাবাসে যেন মুজিবকন্যার ভেতর জন্ম নেয় অপ্রতিরোধ্য এক ‘রাষ্ট্রনায়ক’। এ পর্যায়ে এসে দলের উচ্চাভিলাষী নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত করে এনে তিনি হয়ে ওঠেন দল ও জোটের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী।

ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দুই মাসের মাথায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ধকল সামলে নিয়েই তিনি হাত দেন অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান তৈরির কাজে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করে তিনি ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বাঁধভাঙা এক দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে তোলেন। দেশ পরিচালনার পাশাপাশি শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের খেলাধুলারও সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আজ লাল-সবুজ পতাকাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, উন্মেষ ঘটেছে গর্বিত এক জাতিসত্তার। এ দেশের নতুন প্রজন্মকে এখন আর খেলার মাঠে পাকিস্তান কিংবা ভারতের পতাকা নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় না।

একটু দেরিতে হলেও নারীর ক্ষমতায়নের ঝান্ডাও উড়েছে শেখ হাসিনার হাতেই। রাষ্ট্র ও সরকারের অনেক বড় বড় পদ একেবারে পরিকল্পনা করেই তিনি নারী নেতৃত্বের হাতে তুলে দেন। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতেও বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে নারী ও কিশোরী ক্রীড়াবিদেরাও। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার ও অগ্রসর এই জননেত্রী, যা ইতিমধ্যেই সুশাসনের এক বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পোশাকশিল্পের পাশাপাশি এ খাতও হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সম্ভাবনাময় একটি খাত।

২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শেখ হাসিনা যখন দেশ ও জাতি গঠনের কাজে ব্যস্ত, অকস্মাৎ তাঁর সামনে আসে ২০১৩ সালের ৫ মের হেফাজত–তাণ্ডব এবং বিএনপি-জামায়াতের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন এবং টানা ৯০ দিন জ্বালাও–পোড়াওয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পরাজিত করার মরণপণ আক্রমণ। তত দিনে তিনি সব ষড়যন্ত্র ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার অনির্বাণ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছেন। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে একতরফা নির্বাচনও মেনে নেয় দেশের মানুষ, পাশে দাঁড়ায় গোটা পৃথিবী। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্মাণের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা অপর পক্ষের সবচেয়ে মৌল চাহিদাকে আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে ধারণ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে অত্যন্ত লাগসই এক ভারসাম্যের কূটনীতির সূচনা করেন, যা গোটা বিশ্বে এখন প্রশংসিত একটি দৃষ্টান্ত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য পাশ্চাত্য দেশগুলোর কাছেও বাংলাদেশ এখন মানবিক উন্নয়নের এক রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিলারি ক্লিনটন ক্ষমতায় না আসায় খানিকটা স্বস্তি মিললেও বাংলাদেশ সম্পর্কে হেনরি কিসিঞ্জারের ১৯৭১ সালের নীতি মার্কিনরা আজও এতটুকু বদলায়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের এদেশীয় এজেন্টদের একহাত দেখে নিয়েই শেখ হাসিনা আজ ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকেও আজ রোহিঙ্গা প্রশ্নে শেখ হাসিনার সুরেই কথা বলতে হচ্ছে। তথাপি জাতিসংঘে জেরুজালেম বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে ভোট দিতে শেখ হাসিনা এতটুকু দ্বিধান্বিত হননি।

কিন্তু আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক হেফাজত–সংস্রবে দলটির অন্তর্গত চেতনাকেই গুলিয়ে ফেলার আশঙ্কা দেখে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উন্মাদনার মুখে অসাম্প্রদায়িক এ সংগঠনের মৌল চরিত্র ধরে রাখাও শেখ হাসিনার সামনে এখন বড় একটা চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতিতে পুলিশের কিছু কিছু সদস্যও যেন লাগামহীন হয়ে পড়েছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও খানিকটা বেপরোয়া ভাব লক্ষণীয়। মাত্রা ছাড়া ঘটনা ঘটেছে নিম্ন ও উচ্চ আদালতেও। বিশ্বের অপরাপর গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় উন্নয়নসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিও যেন একটু বেশি দৃশ্যমান। এসবই বঙ্গবন্ধুর কন্যার জন্য বড় ধরনের অশনিসংকেত। তবে ব্যাংকিং সেক্টর এবং শেয়ার মার্কেটই শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দেবে।

আওয়ামী লীগের ১০ বছরের শাসন আমলে সুশাসনের প্রশ্নে ব্যত্যয়ের একটি নাতিদীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করা হয়তো কোনো কঠিন কাজ হবে না, কিন্তু সেসবের লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা কেবল শেখ হাসিনারই রয়েছে। তাঁর আমলেই কেবল সরকারের অনেক বড় বড় মন্ত্রী, এমপিদের দুদকের বারান্দায় হাঁটতে দেখা গেছে। তবে সবকিছু ডিঙিয়ে কূটনৈতিক ভারসাম্য, অসাম্প্রদায়িক সুরক্ষা, উন্নয়ন ধারাবাহিকতা এবং মানবিক উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশে আজ শেখ হাসিনার কোনো দূরবর্তী বিকল্পও নেই। তাঁর হাত ধরেই জাতিকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তাঁর কাছে দেশবাসীর এখনো বহু কিছু পাওয়ার আছে। তবে মাইক্রো ম্যানেজের পর্যায় অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার দায়িত্ব শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে। নিশ্চয়ই তাঁর হাতেই তৈরি হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা ও উত্তরাধিকার। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের পাশাপাশি সামাজিক উষ্ণায়ন এবং নিজ দলের দক্ষিণমুখী যাত্রা রুখতে হবে তাঁকেই। বাঙালির হাজার বছরের মুক্তিসংগ্রামের দায়ভার তিনিই তো নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

মোজাম্মেল বাবু : একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও কলামিস্ট