পুরোটাই 'সরকার'

জাতীয় নির্বাচনের আগে দলীয় প্রধানদের বিটিভিতে ভাষণ দিতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আগেও ছিল না, এখনো নেই। তবে রেওয়াজ ছিল। প্রধান প্রধান দলের নেতারা বিটিভিতে দেওয়া ভাষণে নিজেদের অবস্থান এবং নিজেদের ইশতেহারে থাকা ওয়াদার কথা তুলে ধরবেন, এত দিন এমনটিই চলে আসছিল। কিন্তু এবার ব্যত্যয় হলো। এ বছর নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিটিভিকে এ ধরনের নির্দেশনা দেয়নি। তাই বিটিভিতে দলীয় প্রধানদের ভাষণও হয়নি।

বিটিভিতে সারা বছর সরকারের উন্নয়ন ও বিরোধীদের সমালোচনার খবরকেও দেশবাসী একপ্রকারের ‘রেওয়াজ’ বলেও মেনে নিয়েছে। সেই রেওয়াজের মধ্যে আগে অন্তত এটুকু ছিল যে নির্বাচনের দিন কয়েক আগে থেকে বিটিভি ও বেতারে সব দলের খবর কম-বেশি সম্প্রচার করত। প্রথম আলো ২২ থেকে ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের সংবাদ বিশ্লেষণ করে যে চিত্র পেয়েছে, তাতে সেখানেও নজিরবিহীন ব্যত্যয় দেখা গেল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারের নির্বাচনকেন্দ্রিক সংবাদে সরকারি দল ও তাদের শরিকদেরই নিরঙ্কুশ প্রাধান্য। সরাসরি নির্বাচনী প্রচারণার সংবাদে ৯০ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে সরকারি দলের প্রার্থীদের জন্য। ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপিসহ অন্যরা যে সামান্য সময় পেয়েছে, তার মধ্যেও সরকারি দলের বিপক্ষে যায়, এমন প্রসঙ্গ ছিল না। আর নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অন্য খবর ও অনুষ্ঠানগুলো এমনভাবে পরিবেশিত হয়েছে, যাতে তা শাসক দলের পক্ষে যায়।

২২ থেকে ২৬ ডিসেম্বর বিটিভির আধা ঘণ্টা করে প্রচারিত পাঁচ দিনের রাত আটটার সংবাদে ১২০ মিনিট নির্বাচনসংক্রান্ত খবর ছিল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের শরিকদের দেওয়া হয় ১০১ মিনিট। আর ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি পায় ২ মিনিট ১০ সেকেন্ড। বাকিটা নির্বাচনসংক্রান্ত অন্যান্য খবর।

আর বেতারের ১৫ মিনিট করে প্রচারিত পাঁচ দিন রাত সাড়ে আটটার খবরে ৫১ মিনিট ছিল নির্বাচনসংক্রান্ত সংবাদ। এর মধ্যে ৩৭ মিনিট ১৩ সেকেন্ড ব্যয় হয় মহাজোটের জন্য। বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট পায় ২ মিনিট ৫০ সেকেন্ড। বেতার-টিভিতে সরকারি দলের এমন প্রাধান্য যে অন্যায্য, তা বুঝতে হলে তথ্যবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। এই হতাশাব্যঞ্জক খবরের সঙ্গে আরও হতাশা ঢেলে দিয়েছেন খোদ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তাঁর ভাষায়, ‘ঐক্যফ্রন্টের খবর তৈরিই হচ্ছে না। সে জন্যই সংবাদে তারা স্থান কম পাচ্ছে।’ তথ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য কতখানি বিশ্বাসযোগ্য, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু বেতার-টিভিতে সরকারি দলের প্রাধান্য এবং বিরোধী দলের সংবাদ না থাকা যে অসমতল নির্বাচনী মাঠের একটি উদাহরণ, তাতে কারোর সন্দেহ থাকার কথা নয়।

বিটিভি-বেতার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম। জনগণের অর্থে এসব প্রতিষ্ঠান চলে। জনগণের পয়সায় চলা এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি বা বিরোধী দলের প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। এই সহজ বিষয়টি সবারই উপলব্ধিতে আনা দরকার।