'বর্ণবাদী' গান্ধী এবং আফ্রিকার প্রতিশোধ

গত ডিসেম্বরে আফ্রিকার দেশ ঘানার রাজধানীর ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বর্ণবাদী অভিযোগে গান্ধির একটি ভাস্কর্য অপসারণ করে। মূর্তিটি ২০১৬ সালে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি উন্মোচন করেছিলেন।
গত ডিসেম্বরে আফ্রিকার দেশ ঘানার রাজধানীর ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বর্ণবাদী অভিযোগে গান্ধির একটি ভাস্কর্য অপসারণ করে। মূর্তিটি ২০১৬ সালে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি উন্মোচন করেছিলেন।

কিছুদিন আগে আফ্রিকার দেশ ঘানার রাজধানী আক্রায় ইউনিভার্সিটি অব ঘানা থেকে গান্ধীজির মূর্তিটি সরিয়ে ফেলতে হলো! ২০১৬ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি মূর্তিটি উন্মোচন করার পরপরই সেটি সরানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে ওঠে। তাঁরা তাঁদের দাবির পক্ষে একটি পিটিশনে গান্ধীকে ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় তিনি ভারতীয়দের আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে উন্নততর জাতি হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর বিভিন্ন লেখায় আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ‘বর্বর’, ‘অসভ্য’, ‘কাফ্রি’ বলে উল্লেখ করেছেন। গান্ধীর বিরুদ্ধে ভারতে বর্ণপ্রথা টিকিয়ে রাখা সমর্থন করার অভিযোগও করা হয় এই আবেদনে।

এ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘#GhandiMustFall’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়। মূর্তিটির পতনকে আন্দোলনকারীরা তাঁদের বিজয় হিসেবে দেখছেন। আফ্রিকার অন্য আরেকটি দেশ মালাওয়িতে গান্ধীজির মূর্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ আন্দোলনের মুখে সম্প্রতি স্থগিত করেছেন সে দেশের হাইকোর্ট।

দুই.
একজন ধনাঢ্য গুজরাটি মুসলমান ব্যবসায়ীর আইন উপদেষ্টা হিসেবে বিলেতফেরত ব্যারিস্টার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৮৯৩ সালে ভারত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলেন ফ্রক কোট ও পাগড়ি পরে। ১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে গুজরাটি সাধারণ কৃষকের পোশাকে তিনি বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) বন্দরে জাহাজ থেকে নামেন। ইতিমধ্যে ভারতের মানুষের কাছে তাঁর যে ইমেজ গড়ে উঠেছিল, তা বর্ণবাদ ও ব্রিটিশবিরোধী এক সন্ত-রাজনীতিবিদের ইমেজ, যিনি অহিংস সত্যাগ্রহ দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, জেল-জুলুমকে তুচ্ছ করেছেন। কিছুদিন পর তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ‘মহাত্মা’ উপাধি দেন।

কিন্তু গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায় আসলে কী করেছিলেন, সে বিষয়ে ভারতের, এমনকি আফ্রিকার মানুষের ধারণা ছিল ভাসা–ভাসা। গান্ধীর নিজের লেখা এবং তাঁর ভক্ত জীবনীকারদের লেখা থেকে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার জীবনের একটি খণ্ডিত চিত্র পাওয়া যেত। বছর দুয়েক আগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকীয় দুজন অধ্যাপক আশ্বিন দেশাই ও গুলাম ওয়াহেদের গবেষণা গ্রন্থ ‘দ্য সাউথ আফ্রিকান গান্ধী: স্ট্রেচার বেয়ারার অব দ্য এম্পায়ার’ প্রকাশের পর গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় জীবন সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য বেরিয়ে আসে। সামনে উঠে আসে গান্ধীজির অন্য এক রূপ।

তিন.
ঊনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় মূলত দুই ধরনের ভারতীয় ছিলেন—আখ চাষের খামারে, কয়লাখনিতে ও রেললাইন নির্মাণকাজে নিয়োজিত দরিদ্র চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক এবং গুজরাট থেকে আসা মুসলমান ও হিন্দু ব্যবসায়ী সমাজ।

দক্ষিণ আফ্রিকার দখলদার শ্বেতাঙ্গরা কালো আফ্রিকানদের মতো ভারতীয়দেরও বর্ণবাদী বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখত। দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পর গান্ধীজিও এই বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তবে তাঁর আন্দোলন ছিল ভারতীয়দের, মূলত ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রতি ইউরোপীয়দের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে।

গান্ধীর যুক্তি ছিল, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা হিসেবে। ব্রিটেনের মহারানির ১৮৫৮ সালের ঘোষণা অনুযায়ী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সব প্রজার সমান অধিকার থাকার কথা। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের শ্বেতাঙ্গদের সমান সামাজিক অধিকার থাকা উচিত। ১৮৯৪ সালে তিনি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন নাটাল ন্যাশনাল কংগ্রেসের সেক্রেটারি হন। ভারতীয়দের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক শাসকদের নানা বৈষম্যমূলক কালাকানুনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের নিয়ে নিরলসভাবে তিনি অহিংস ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। নানা কারণে নির্যাতিত, অপমানিত হন, জেল খাটেন।

চার.
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর বর্ণবাদী ইউরোপীয়দের নির্মম শোষণ-নির্যাতনে গান্ধী কোনো সমস্যা দেখেননি। ‘আফ্রিকা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘কালো ঘোমটার নিচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবতা রূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।’

গান্ধীজির দৃষ্টিতেও আফ্রিকার কালো মানুষদের মানবতার রূপ উপেক্ষিত হয়েছে। তাদের ‘ভাষাহীন ক্রন্দন ধ্বনি’ তাঁর কানে পৌঁছায়নি।

দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের চরম বৈষম্যমূলক আচরণ গান্ধী মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এটি মেনে নিতে পারেননি যে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা ‘সভ্য’ ভারতীয়দের আফ্রিকার ‘অসভ্য কাফ্রিদের’ কাতারে নামিয়ে দেবে। তাই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, ভারতীয়রা আসলে ইউরোপীয়দের মতো একই ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত!

কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের থেকে ভারতীয়দের পৃথক সুবিধার জন্য গান্ধী শ্বেতাঙ্গ কর্তৃপক্ষের কাছে নিরলস দেনদরবার করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর ওঠাবসা–চলাফেরা ছিল বিত্তশালী ভারতীয় ব্যবসায়ী ও শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে। কৃষ্ণাঙ্গদের সংস্পর্শ তিনি এড়িয়ে চলতেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আফ্রিকার বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসান চাননি, চেয়েছেন সেই ব্যবস্থা অটুট রেখে ভারতীয়দের, বিশেষত ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য শ্বেতাঙ্গদের মতো সুযোগ-সুবিধা।

পাঁচ.
দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর আন্দোলনের কোনো ব্রিটিশবিরোধী চরিত্র ছিল না। তিনি একান্তভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ব্রিটিশ সরকারের অনুগত ছিলেন। ১৮৯৯ সালে ‘বোয়ার যুদ্ধে’, অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকায় বসতকার (সেটেলার) ওলন্দাজ এবং ব্রিটিশদের মধ্যে যুদ্ধে, গান্ধী অ্যাম্বুলেন্স বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের পরিচর্যায় নিয়োজিত হন এবং ‘সার্জেন্ট মেজর’ পদ লাভ করেন। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের তৈরি বিভিন্ন ‘কনসেনট্রাশন ক্যাম্পে’ হাজার হাজার বোয়ার এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী-শিশু প্রাণ হারায়। ব্রিটিশদের এই নির্মমতা গান্ধীকে বিচলিত করেনি।

১৯০৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ জুলুরা বিদ্রোহ করলে ব্রিটিশ সরকার নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। এই যুদ্ধে সাড়ে তিন হাজার জুলু নিহত, সাত হাজার আহত ও ত্রিশ হাজার গৃহহারা হয়। এই অসম যুদ্ধেও গান্ধী শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের সেবার জন্য অ্যাম্বুলেন্স বাহিনী তৈরি করেন। তিনি জুলুদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের দিয়ে সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করার প্রস্তাবও করেন!

গান্ধী তাঁর এই ব্রিটিশ আনুগত্যের জন্য যারপরনাই গর্বিত ছিলেন। ভারতে ফিরে আসার পাঁচ বছর পর ১৯২০ সালে ভারতবাসী ইংরেজদের কাছে লিখিত এক খোলা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমি বিনীতভাবে বলতে চাই যে গত টানা ২৯ বছর আমি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যেরূপ সহযোগিতা করেছি, আর কোনো ভারতীয় তা করেনি। আমি যেরূপ বৈরী পরিবেশে এই সহযোগিতা করেছি, অন্য কেউ হলে বিদ্রোহ করত।’

ছয়.
তবে শ্বেতাঙ্গদের সহিংসতার বিরুদ্ধে গান্ধীর আপসকামী রাজনীতি ও অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে বিশেষ ফল না হওয়ায় গান্ধীর প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়দের আস্থা ধীরে ধীরে কমে আসে। তাঁর নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের মিশনারি স্কুলে শিক্ষিত সন্তানেরা ভারতকে নয়, দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিজেদের দেশ মনে করত। তারা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থমুখিন গান্ধীর আন্দোলনে অনাগ্রহী হয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে।

শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই নয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ১৯১৩ সালের আগে ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের চুক্তির মেয়াদ শেষে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতে হলে তিন পাউন্ড ট্যাক্স দেওয়ার একটি আইনের বিরুদ্ধে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছিল। ১৯১৩ সালে গান্ধী ও তাঁর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সমর্থনে তিন পাউন্ড ট্যাক্সের বিরুদ্ধে খনিশ্রমিকদের আন্দোলন গড়ে ওঠে। গান্ধীর অনাগ্রহ সত্ত্বেও এই আন্দোলন দ্রুত চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় আখশ্রমিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এবং সহিংস আকার ধারণ করে গান্ধীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই আন্দোলনের পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গান্ধী ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অকার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতি ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে।

সাত.
এদিকে ভারতের রাজনীতিতে তখন গান্ধীর মতো একজন নেতার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কারণ, ভারতে তখন আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির পর্ব শেষ হয়ে মধ্যবিত্তের মধ্যে সহিংস সন্ত্রাসবাদী বা ‘বিপ্লবী’ আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রয়োজন ছিল ভারতের জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনুগত ও নির্ভরযোগ্য একজন লোক। আবার ভারতীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়েরও দরকার ছিল একজন দক্ষ কিন্তু বিশ্বস্ত লোক, যিনি আন্দোলনে যাতে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়, তা নিশ্চিত করতে পারবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই দুপক্ষের স্বার্থে কাজ করা পরীক্ষিত লোক ছিলেন গান্ধী।

তাই দেখি, গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারত আসার আগে বিলেত যাচ্ছেন। সেখানে লর্ড হার্ডিঞ্জ গান্ধীকে ‘হিন্দ’, অর্থাৎ ভারতে আসার আগেই ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ বা ‘হিন্দুস্থানের বাদশাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসে গান্ধী তৎকালীন বোম্বে পৌঁছান। ভারতে পৌঁছার পর কয়েক বছরের মধ্যেই পরম ব্রিটিশভক্ত ‘মহাত্মা’ গান্ধী ভারতের শিল্পপতি-ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সমর্থনে ভারতের ‘ব্রিটিশবিরোধী’ রাজনীতিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন এবং তাঁর মতাদর্শের আদলে কংগ্রেসের রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারণ করেন।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ, প্রাবন্ধিক
[email protected]