সাংসদদের শপথ

নবনির্বাচিত সাংসদদের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হলো। বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটা নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বে যে আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল, নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার পর তা আর থাকল না। কারণ, নতুন সংসদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয়ের ফলে দলভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত কম। উপরন্তু বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত সাংসদেরা শপথ না নেওয়ায় বহুদলীয় প্রতিনিধিত্বমূলক জাতীয় সংসদের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে।

প্রতিনিধিত্বশীল, কার্যকর ও ফলপ্রসূ সংসদের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তার কথা বললে আমাদের হতাশার কথাই বলতে হয়। কারণ, এ দেশে এমন সংসদ আমরা খুব কম পেয়েছি। যখন সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল, তখনো সংসদ বর্জন, বিরোধীদলীয় সাংসদদের কথা বলার সময় মাইক বন্ধ করা, ঘন ঘন ওয়াকআউট ইত্যাদি কারণে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কোনো কোনো সংসদে কোরাম–সংকট দৃষ্টিকটু পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।

সদ্য বিগত দশম জাতীয় সংসদও সত্যিকার অর্থে কার্যকর ও ফলপ্রসূ ছিল না। সেটি ছিল কার্যত বিরোধী দলবিহীন এক জাতীয় সংসদ। এবারও জাতীয় পার্টি সরকার গঠনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দিলে আমরা জাতীয় সংসদে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি দেখতে যাচ্ছি। এর অর্থ কি এই যে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র বিরোধী দলবিহীন সংসদের যুগে প্রবেশ করেছে? রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার জন্যও এটা খুব জরুরি।

জাতীয় সংসদে একটি দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকাশের ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে, সে সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সাংসদদের সংখ্যাগুরু অংশ একই দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বলে সংসদে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে মতভেদ ও তর্ক-বিতর্ক হতে পারবে না এমন কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। আমরা মনে করি, সংবিধানের ৭০ ধারা বাতিল করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত। জাতীয় সংসদের প্রধান দায়িত্ব আইন প্রণয়ন ও সরকারের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; একাদশ জাতীয় সংসদে এই দায়িত্বের প্রায় পুরোটাই বর্তাবে সরকারি দলের সাংসদদের ওপর। সাংসদেরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের আশা-প্রত্যাশার দিকে দৃষ্টি দেবেন—এটা যেমন স্বাভাবিক প্রত্যাশা, তেমনি জাতীয় স্বার্থে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরোনো আইনগুলোর প্রয়োজনমাফিক সংশোধনের কাজে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। আমরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে চাই সরকারি নীতি-কর্মসূচি ও কর্মসম্পাদনের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সংসদের কার্যকর ভূমিকা পালনের ওপর।

আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা জনস্বার্থের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপের ওপর জোর দিতে চাই। জনস্বার্থের অনুকূল নয় এমন নতুন আইন প্রণয়ন করা থেকে বিরত থাকা উচিত। বিদ্যমান যেসব আইন বা কোনো আইনের কোনো ধারা বা বিধানের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত রয়েছে, আমরা সেগুলো বাতিল বা সংশোধন করার আহ্বান জানাই। এই আহ্বান সরকারি দলের সাংসদদের প্রতিই। নতুন সংসদের সদস্যদের প্রতি আমাদের আহ্বান, বহুনিন্দিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা সংশোধন করার উদ্যোগ নিন। সংসদের অধিবেশনে এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হোক।

জাতীয় সংসদকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার একটি কার্যকর উপায় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর অবিরাম কার্যকারিতা নিশ্চিত করা। কার্যত বিরোধী দলহীন জাতীয় সংসদে স্থায়ী কমিটিগুলোই শেষ ভরসার স্থল। দুর্নীতির লাগামহীন বিস্তার রোধ করাসহ গুরুতর জাতীয় সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর চাপ অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। আমরা আশা করব, নতুন সংসদের নজরদারিতে নতুন সরকার দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ ও অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে তৎপর হবে।