দুর্ভাবনার কুয়াশা সরিয়ে আলো আসুক

আমাদের দুর্ভাবনার কুয়াশা কেটে যাক, রোদে ঝলমল করে উঠুক আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ
আমাদের দুর্ভাবনার কুয়াশা কেটে যাক, রোদে ঝলমল করে উঠুক আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ

বছরের প্রথম দিনের সকালবেলা হাজির হয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে, সেখানে ছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বই উৎসব। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা এসেছিল, তাদের অভিভাবকেরা ছিলেন। শিক্ষার্থীরা বই পেল, রঙিন বই।

পৌষের ভোরটা ছিল কুয়াশাঢাকা, তারপর হয়ে উঠল রোদ-ঝলমলে, আর রঙিন জামাকাপড় পরা ছেলেমেয়েদের মনে হচ্ছিল একঝাঁক পরি। রোদে কি বাচ্চারা কষ্ট পাচ্ছে? রসিকতা করে বললাম, শোনো, রোদে ভিটামিন ডি আছে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তখন বললেন, এই যে দেখো, মঞ্চে আছেন সাকিব আল হাসান, তাঁরা যখন ক্রিকেট মাঠে খেলেন, তখন কি কেউ তাঁদের মাথায় ছাতা ধরে থাকে?

আমি তো কিশোর আলোর কিশোর-কিশোরীদের বলি, এর সবই ট্রেনিং। এই যে তোমরা কিশোর আলোর অনুষ্ঠানগুলোয় আসো, তখন কি বাসে কিংবা রিকশায় কেউ তোমাদের জিজ্ঞেস করে, এ প্লাস বি হোল স্কয়ারে কী হয়? এই জ্ঞানগুলো কাজে লাগে, কাজে লাগে বলেই বিমান আকাশে ওড়ে, কিন্তু জীবন মানে কেবল বইয়ের জ্ঞান নয়। শক্তপোক্ত হয়ে বড় হও, বাইরের পৃথিবীর বিরূপ পরিবেশেও টিকে থাকতে শেখো।

ছোটবেলায় কোনো দিনও নতুন বই পড়ার এবং নতুন জুতা পরার সুযোগ পাইনি। ৪ নম্বর ছিলাম ভাইবোনের মধ্যে, বড় ভাইবোনের ব্যবহৃত বই বছর শেষে পেতাম আর বড় ভাইদের ছোট হয়ে যাওয়া জুতা পরার সৌভাগ্য অর্জন করতাম। সেই বাংলাদেশ আজ কতটা সক্ষমতা অর্জন করল! এক দিনে ৩৩ কোটি বই বিলি করা হচ্ছে। ঝকঝকে নতুন বই। মুহম্মদ জাফর ইকবাল হিসাব করে বলেন, এই ৩৩ কোটি বই একটার পাশে আরেকটা রাখলে সারা পৃথিবীকে তিনবার প্রদক্ষিণ করতে পারবে!

একজন টিভি সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘বইয়ে ছাপার ভুল থাকে, এ নিয়ে কিছু বলুন।’ বই সম্পাদনা করা, বই পরিমার্জনা করা, প্রুফ দেখা—এগুলো বিশেষায়িত কাজ, যাঁর কাজ, তাঁকেই যেন করতে দেওয়া হয়। পেশাদার সম্পাদক, সংশোধক নিয়োগ করতে খুব সামান্য টাকাই লাগবে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের এটা খুব সামান্য অংশ, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা যেন অবশ্যই করা হয়।

২.
আজ থেকে কুড়ি বছর পরে বাংলাদেশ হবে একটা আলোকিত উন্নত বাংলাদেশ। এ আশার পেছনে অনেকগুলো গাণিতিক বাস্তবতা কাজ করে।

এখন আমাদের প্রায় ৯৯ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। আমরা যদি এদের ঝরে পড়া রোধ করতে পারি, এদের লেখা, পড়া, হিসাব কষা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে পারি, বাকি কাজটা এরা নিজেরাই করে নিতে পারবে। মানুষ একটা আশ্চর্য সৃষ্টিশীল প্রাণী, অমিত সম্ভাবনার আকাশ প্রত্যেকের ভেতরে রাখা আছে। শিক্ষা হলো পরশপাথর। মানুষের সেই সম্ভাবনার দরজা শিক্ষা খুলে দেয়। মাটির মানুষ সোনার মানুষে পরিণত হয়।

এখানে আমাদের কতগুলো চাওয়া আছে। মানসম্পন্ন শিক্ষা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। ছেলেমেয়েরা যেন স্কুলে যায় এবং শেখে। তারা লেখাপড়া করুক, খেলাধুলা করুক, নৈতিক শিক্ষা লাভ করুক এবং সংস্কৃতির চর্চা করুক। ২০ বছর পরে এই দেশের কৃষক হবেন শিক্ষিত কৃষক, শ্রমিক হবেন শিক্ষিত শ্রমিক। এখনই কিন্তু সেই শিক্ষিত কৃষক, শিক্ষিত শ্রমিকের সৃষ্টিশীল উদ্যোগের সুফল আমরা পাচ্ছি। কৃষিক্ষেত্রে, শিল্পক্ষেত্রে বিপ্লব আপনা–আপনি আসেনি।

দুই নম্বর দাবিটা আবারও জোরের সঙ্গে করি। ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ অভিবাসী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। আমাদের অভিবাসী জনশক্তি যাচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। পরিকল্পনা করে এই শ্রমজীবীদের পেশাজীবীতে উন্নীত করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই সূত্রটা প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। একই সঙ্গে আমাদের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধি, দক্ষতা, যোগ্যতা আরও বাড়িয়ে প্রবাসীদের কল্যাণ ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দূতাবাসগুলোতেও অভিবাসীদের কল্যাণ ও মর্যাদা হওয়া উচিত এক নম্বর অগ্রাধিকার।

এখনই আমাদের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিদেশে আছে। ১০ বছরে আরও ১ কোটি যাবে। গাণিতিক হারে না বেড়ে সংখ্যাটা জ্যামিতিক হারে বাড়লে ২০২৮ সালে ৩ কোটি মানুষের বিদেশে থাকার কথা। তারা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাবে। এদিকে দেশেও যদি সবাই শিক্ষিত ও দক্ষ হয়, তাহলে অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহের বিপ্লব চলতে থাকবে। এই সময়টায় দরকার হবে সুশাসন। দুর্নীতিমুক্ত কর্মপরিবেশ। বিদ্যুৎ। ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা এবং বিদেশে টাকার অবৈধ পাচার রোধ। দরকার হবে নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তার বোধ।

একটা বিষয় নিয়ে অগণিত গবেষণা হচ্ছে, অনেকগুলো গবেষণা প্রতিবেদন ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়, তা হলো—সুশাসনের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের সম্পর্ক। সুশাসন ভালো হলে যেমন আয় বাড়ে, তেমনি মাথাপিছু আয় যেসব দেশে কম, সেসব দেশে সুশাসন আসে না। পশ্চিম লন্ডনের ব্রুনেই ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পাবলিক হেলথ রিসার্চ বলছে, মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে শুধু সুশাসনের সম্পর্ক আছে তা-ই নয়, জনস্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ইত্যাদিরও সম্পর্ক আছে। আমরা আশা করি, ১০-২০ বছর পরে যখন আমাদের মাথাপিছু আয় আরও বাড়বে, তখন আমাদের দেশে সুশাসনও আরও আসবে।

শঙ্কাও আছে কতগুলো। এবারের ভোটের পর সংসদে কার্যকরী বিরোধী দল থাকছে না। অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, যে দেশে গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। কারণ, দেশের কোথাও খাদ্যাভাব দেখা দিলে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবে আর সরকার যেহেতু জনগণের ভোট প্রত্যাশা করে, তারা দ্রুতই ব্যবস্থা নেবে। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা অব্যাহত থাকবে তো? গণমাধ্যমে অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করতে দেওয়া হবে তো? দেশের মানুষের প্রকৃত কোনো দুঃখ লাঘবে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে তো?

দ্বিতীয় শঙ্কাটা পরিবেশ নিয়ে। প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে। উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, মুনাফা কিন্তু অন্ধ মত্ত হস্তীর মতো; তা পায়ের নিচে বন, জলাভূমি, মাটি, সবকিছু তছনছ করে ফেলে। আমরা যেন আমাদের পরিবেশকে উন্নয়ন এবং গৃধ্নুতার বলি না করি।

আর সবকিছুর মূলে যেন থাকে মানুষ। বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন, ‘আমার গরিব-দুঃখী মানুষ’। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও সব সময় গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলেন। আমার এক স্থপতি বন্ধুর মুখে শুনেছি, তাঁরা যখন ঢাকার একটা সৌন্দর্য ও জলাশয় প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী একটা কথাই বলেছিলেন, গরিব মানুষের যেন ক্ষতি না হয়, তাদের যেন পুনর্বাসন করা হয়। এই নীতিটা যেন সর্বত্র বজায় থাকে।

নতুন সরকার শিগগিরই শপথ নেবে। তারা যেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারটা ভুলে না যায়। ইশতেহারে আছে, ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হবে এবং সংবিধান হবে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ দলিল।’

‘আইনের শাসনের মূল বক্তব্যই হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান; কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’

‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা হবে।’

‘সর্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হবে।’

রোমান সম্রাট দার্শনিক মার্কেস অরেলিয়াস (১২১-১৮০) বলেছিলেন, ‘যদিও কেউই অতীতে ফিরে যেতে পারবে না, ব্র্যান্ড নিউ আরম্ভ করতে পারবে না; কিন্তু যে কেউই শুরু করতে পারবে এখনই, এবং রচনা করতে পারবে একটা ব্র্যান্ড নিউ সমাপ্তি।’

আজকের দিনটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজ থেকেই নবোদ্যমে শুরু করুন, যাতে শেষটা সুন্দর হয়, ফলটা শুভ হয়। আর সে জন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারই যথেষ্ট। আর আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা, আছে অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা। তাঁর অমূল্য বাণী ‘বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না’ এবং চিরদিনের অনুপ্রেরণা, ‘মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।’

পয়লা জানুয়ারির সকালটার মতো আমাদের দুর্ভাবনার কুয়াশা কেটে যাক, রোদে ঝলমল করে উঠুক আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক