মার্কিন বাহিনী সরিয়ে আনা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে?

সিরিয়ায় মার্কিন সেনাবাহিনীর অভিযান। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ায় মার্কিন সেনাবাহিনীর অভিযান। ছবি: রয়টার্স

সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে আসার ঘোষণাকে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান—উভয় দলের সমর্থকেরা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। দুই দলের সমর্থকেরাই মনে করেন, বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি থাকা অপরিহার্য। তাঁরা মনে করেন, যেসব জায়গায় মার্কিন সেনা মোতায়েন করা আছে, সেখান থেকে সরে এলে সেই শূন্যস্থান প্রতিপক্ষ দখল করে নেবে এবং তাতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়ে যাবে। তাঁরা মনে করছেন, সিরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনী সরিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ভয়ানক অস্থিরতা তৈরি হবে। মার্কিন অনুপস্থিতির সুযোগে সেখানে রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এতে নতুন করে সংঘাতের সূচনা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর গোড়া থেকেই সিরিয়ায় সেনা মোতায়েনকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে দাবি করে এসেছে। তারা বলে এসেছে সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর অংশ হিসেবে সেখানে মার্কিন সেনা মোতায়েন অপরিহার্য। এখন সেখানে আইএস পরাজিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। ফলে ট্রাম্প মনে করছেন সেখানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি অর্থহীন। তিনি মনে করছেন এখন আর তাদের সেখানে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটি বোঝা কঠিন নয়, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কারণে লাভবান হবেন সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের আলী খামেনি। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কারণে ইসরায়েল সেখানে একা হয়ে পড়বে। কুর্দিদের সঙ্গে স্পষ্ট প্রতারণা করা হবে। এ ছাড়া এমন সব জটিলতা তৈরি হবে, যা আঞ্চলিক অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রাজনীতিবিদেরা যে চরম সত্য কথাটি কখনোই বলতে পারবেন না বা স্বীকার করবেন না, সেটি হলো মার্কিন বাহিনী আসলে সিরিয়ায় (একইভাবে ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, হর্ন অব আফ্রিকা, লিবিয়া এবং আশপাশের আরও অনেক এলাকায়) আইএস দমনের উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি। এসব এলাকায় মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য আইএস একটি মোক্ষম অজুহাত মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখাই মূলত সেখানে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির মূল কারণ।

সিরিয়ায় বাশার আল–আসাদকে সরিয়ে সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা উচিত এবং সেটি করার জন্যই সেখানে মার্কিন সেনা থাকা দরকার—এমন কথা বলার নৈতিক অধিকার আমেরিকার নেই। এর কারণ হলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে সেই সৌদি আরবের গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার মাথাব্যথা নেই। সেই সৌদি আরবের রাজতন্ত্রকে আমেরিকা প্রথম থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। এটি মনে করার কোনো কারণ নেই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ২০১১ সালে সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়েছিল। এর একমাত্র কারণ ছিল বাশার আল–আসাদ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। বাশারের ‘পাপ’ হলো তিনি রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন এবং ইরানের কাছ থেকে সহায়তা নিয়েছেন। এই একমাত্র ‘পাপ করায়’ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাশারকে উৎখাত করতেই হবে।’ বাশারকে সরানোর জন্য তখন আমেরিকা এবং ইসরায়েল, তুরস্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক অংশীজন আসাদবিরোধীদের অস্ত্র, সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক সব সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওবামা সে সময় ‘অপারেশন টিম্বার সাইক্যামোর’ নামের একটি প্রেসিডেন্সিয়াল তদন্তপত্রে সই করেছিলেন। তাতে বাশারকে উৎখাত করার জন্য সিআইএকে সৌদির সহায়তা নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা চেয়েছিলেন সিরিয়ায় মার্কিন সেনা পাঠানো নিয়ে মার্কিন নাগরিকদের দিক থেকে যেন কোনো ধরনের বিরোধিতা না আসে। সে কারণেই তখন বলা হয়েছিল আইএস দমন করতেই সেখানে মার্কিন বাহিনী যাচ্ছে। তবে তারা সেখানে গিয়ে মূলত বাশারবিরোধী জিহাদিদের সব ধরনের সহায়তা করেছে। সেখানে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির কিছুদিনের মধ্যেই সব স্পষ্ট হয়ে গেল। আমেরিকা, ইসরায়েল ও সৌদি আরব একযোগে বাশারকে সরিয়ে দিতে কাজ শুরু করল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিআইএর বাশারকে উৎখাত করার পরিকল্পনা সফল হলো না, কারণ সিআইএর এই তৎপরতার মধ্যেই দৃশ্যপটে রাশিয়া চলে এল। পুতিন বাশারকে সামরিক সহায়তা দিলেন। ইরান তো আগে থেকেই বাশারের সঙ্গে ছিলেন। এতে সিরিয়ায় প্রক্সি যুদ্ধ লেগে গেল। এই যুদ্ধে সেনা ও সাধারণ মানুষ মিলে মোট নিহত হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। সিরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি লোক। এই বাস্তুচ্যুত সিরীয়রা ইউরোপে বন্যার পানির মতো ধেয়ে গেছে এবং গোটা ইউরোপের রাজনীতিকে এটি একটি ঝাঁকুনি দিয়েছে। আইএস নৃশংস ভূমিকায় এসে বেশ কয়েকজন আমেরিকানকে শিরশ্ছেদ করার পর ২০১৪ সালে ওবামা সিরিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দেন। কুর্দি বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে তারা ব্যাপক হামলা চালায়।

এখন ট্রাম্পের যুক্তি হলো, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে উৎখাত করে সেখানে যদি যুক্তরাষ্ট্র পাপেট সরকার বসানো বা সেখান থেকে রাশিয়া ও ইরানকে বিতাড়িত করার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে সেখানে মার্কিন সেনা মোতায়েন রেখে খরচ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো মার্কিন সেনা এখন সেখান থেকে সরিয়ে নিলেই আরও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে। কুর্দিদের নিশ্চিহ্ন করতে উত্তর সিরিয়ায় তুরস্ক অভিযান চালাবে। এখানকার আধিপত্য নিয়ে রাশিয়া ও তুরস্ক ভয়ানক বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে। সিরিয়ায় ইরানের বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসরায়েল তুমুল আক্রমণ শুরু করতে পারে। ইতিমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে ইসরায়েল ও সৌদি আরব জেটবদ্ধ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সিরীয় যুদ্ধ পুরোদস্তুর মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।

এখন হুট করে সিরিয়া থেকে মার্কিন বাহিনীর চলে আসাটা এসব ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে। গোটা অঞ্চলে অস্থিরতা ছড়াবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র এত দিন যেভাবে ভূমিকা রেখে এসেছে, তা থেকে সরে আসাটাও দেশটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাক্স কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক