নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ইতিমধ্যে নবনির্বাচিত সাংসদেরা শপথ নিয়েছেন এবং সরকার গঠনের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু দেশের সবখানে স্বাভাবিক শান্তি ও স্বস্তির পরিবেশ ফিরে আসেনি। ভোট গ্রহণের দিন ও তার অব্যবহিত পরের দিনগুলোতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিহিংসামূলক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। সেসবের মধ্যে ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধও আছে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ‘ধানের শীষে ভোট দেওয়ার অপরাধে’ এক নারীকে আওয়ামী লীগের লোকজন গণধর্ষণ করেছেন—এই অভিযোগের খবরে সৃষ্ট চাঞ্চল্য ও প্রতিবাদ জাতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো অব্যাহত আছে।

এ ধরনের ঘটনা রাজনীতি বা নির্বাচনের অনুষঙ্গ হিসেবে ঘটে থাকলেও এগুলোর সামাজিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে। সরকারি প্রশাসন তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের জরুরি দায়িত্ব এ ধরনের প্রবণতা দমন করা এবং সংঘটিত অপরাধগুলোর আইনি প্রতিকারের লক্ষ্যে যথাযথভাবে আইন প্রয়োগে তৎপর হওয়া।

সুবর্ণচরের ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশি রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে—এটা নির্বাচনের পরে সংঘটিত অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের প্রথম দৃশ্যমান পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে অন্তত এটা মনে হতে পারে যে এসব অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েনি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীসহ আরও যাঁদের মনে প্রতিহিংসামূলক অপরাধ সংঘটনের ভাবনা ক্রিয়াশীল রয়েছে, সুবর্ণচরে পুলিশের এই সক্রিয়তা থেকে তাঁদের কাছে এমন বার্তা যেতে পারে যে অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না। সারা দেশে এ রকম বার্তা পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সে জন্য প্রয়োজন নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন এবং তার পরের দিনগুলোতে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠুভাবে আইন প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আইন প্রয়োগের সংস্কৃতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে। একদিকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মীরা তাঁদের রাজনৈতিক তৎপরতার জন্য এমন অপরাধের অভিযোগে মামলার শিকার হন, যেসব অপরাধ তাঁরা আদৌ করেননি। হাজার হাজার ‘গায়েবি মামলা’ করা হয়েছে, সেগুলোর আসামি করা হয়েছে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতা–কর্মীকে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলা–উপজেলায় বিএনপির অনেক নেতা–কর্মীর প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ডজন ডজন ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। বিএনপির একই নেতার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে, এমন দৃষ্টান্তও কম নয়।

নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও সারা দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মীদের পুলিশি হয়রানি বন্ধ হয়নি। ইতিমধ্যে দায়ের করা মামলার আসামির তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা নেওয়ার অভিযোগ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া যাচ্ছে। যেসব রাজনৈতিক নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, তাঁরা ঘরে ফিরতে পারছেন না। যাঁরা নির্বাচনের পর ঘরে ফিরেছেন, তাঁরাও মামলার কারণে পুলিশি হয়রানির শঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। এই মানুষগুলোর পরিবারে স্বস্তি ফিরে আসেনি।

রাজনৈতিক স্বার্থে আইনের ব্যবহার আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী। শুধু তা–ই নয়, এর ক্ষতিকর প্রভাব সামাজিক সম্পর্কের অত্যন্ত গভীরে যেতে পারে। রাজনৈতিক মত পোষণ করা এবং রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষ আইনের বেআইনি প্রয়োগের শিকার হলে সামাজিক সংহতি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করা ও বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মীদের ভিত্তিহীন অভিযোগে পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।