ভারত প্রত্যাগত রোহিঙ্গা

রোহিঙ্গা-বিষয়ক আরেক নতুন কূটনৈতিক জটিলতার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন উদ্যোগ যখন সফলতার মুখ দেখছে না, তখন ভারত থেকে নতুন বিপদের বার্তা এসেছে। প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বিতাড়নের একটি উদ্যোগের বৈধতা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন আছে। গত অক্টোবরে ৭ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মতিতে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখন দলে দলে রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে দেখছি। এর আগে জবরদস্তি করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য জাতিসংঘ ভারতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কঠোর সমালোচনামূলক বিবৃতি দিলেও দেশটি একে খুব পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হয় না।

আমরা আশঙ্কা করি, গত অক্টোবরে ৭ জনকে মিয়ানমারের হাতে তুলে দেওয়াটা কৌশলগত ছিল। এটা ভারতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ভীতসন্ত্রস্ত করেছে এবং তার পরিণতিতে কমপক্ষে ১ হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে। পরিষ্কার দেখা যায়, সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী পরিচালিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বিশ্বের দেশে দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ভারত তাদের অন্যতম। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদাসম্পন্ন ভারত এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে আচরণ করল, তা দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ভাবমূর্তির সঙ্গে বেমানান। সীমান্তে ভারতীয় নজরদারি সুবিদিত। কিন্তু অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে সীমান্ত গলিয়ে ১ হাজার ৩০০-এর বেশি রোহিঙ্গা বেআইনিভাবে বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে পড়লেও তাদের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। সার্বিক বিচারে মনে হয়, তারা যেন আপদ বিদায় হতে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।

ভারত নিশ্চয়ই শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী হিসেবে গৌরব করতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ এবং ভীতির সঞ্চার হওয়ার দায় তারা এড়াতে পারে না। এর আগে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী যখন মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল, তখন বন্ধুপ্রতিম ভারত, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে প্রত্যাশিত ও যথাযথ ভূমিকা আমরা পাইনি। বাংলাদেশ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের মনোভাব পাল্টানোর চেষ্টার ক্ষেত্রে তাদের সহায়তা প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ সেই সহায়তা তার উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে পায়নি। অথচ বিষয়টির সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতির সম্পর্ক জড়িত।

রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটন ও তাদের পলায়নের পর থেকে এ পর্যন্ত বহির্বিশ্ব থেকে যত ধরনের অভিজ্ঞতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা রোহিঙ্গা সংকটের অবসানে অপ্রতুল থেকে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে ভারত যা করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, তা কোনো অর্থেই বাংলাদেশের প্রতি সুবিচার ও সুনীতি বলে গণ্য হওয়ার নয়। বিশ্লেষকদের অনেকেই ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষার ঐতিহ্যগত রেকর্ড এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি তার চলমান মনোভাবের মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থান লক্ষ করছে।

নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, পুরো তথ্য তাঁরা পাননি। সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পেলে তা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও কূটনৈতিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হিসেবেই বিবেচিত হবে। মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা একটি বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দান আর এখন শান্তিকালীন তৃতীয় একটি বিদেশি রাষ্ট্র থেকে প্রত্যাগত রোহিঙ্গাদের বিনা বাক্য ব্যয়ে আশ্রয়দানের কূটনৈতিক তাৎপর্য ভিন্নতর হতে বাধ্য। দিল্লি বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা সংকটে ঢাকার পাশে থাকার কথা বলেছে, কিন্তু বাস্তবে এর উল্টো অবস্থানই লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের উচিত হবে এ বিষয়ে কথা বলতে দিল্লিতে একটি বিশেষ মিশন পাঠানো। যারা শুধু ভারতের সরকার নয়, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গেও কথা বলে নতুন রোহিঙ্গা স্রোত রোধে পদক্ষেপ নেবে।