জেন্ডার আলোচনায় রাখতে হবে পুরুষকেও

কয়েক বছর ধরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ে নারীর উপস্থাপন নিয়ে জোরালো বাহাস হচ্ছে। আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে পাঠ্যবইয়ে নারীকে উপস্থাপনের বিষয়টি। ২০১৯ সালের জন্য ছাপা হওয়া ষষ্ঠ শ্রেণির গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইয়ে সাদা-কালো সালোয়ার-কামিজ আর সাদা ওড়না গায়ে এক কিশোরীর ছবি। ছবির নিচে লেখা, উপযুক্ত পোশাকে কিশোরী। এই ছবির পাশেই লেখা, ‘তাদের দৈহিক পরিবর্তন অন্যরা দেখে বিরূপ মন্তব্য করতে পারে বলে ভয়ে ভয়ে থাকে। দেহের পরিবর্তন বেশি চোখে পড়ে বলে মেয়েরা অনেক সময় সামনে ঝুঁকে হাঁটে। উপযুক্ত পোশাক পরিধান করলে এ সংকোচ দূর করা যায়।’ (প্রথম আলো, ১০ জানুয়ারি, ২০১৯)

বইয়ে ছাপা ছবি ও উক্ত লাইনগুলো আসলে আমাদের সমাজের লিঙ্গীয় ভাবাদর্শের প্রতিফলন, যার মূল কথা হচ্ছে নারী হচ্ছে একটি শৃঙ্খলিত জাতি। তাঁদের অনেক কিছু সমঝে চলতে হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের কিশোরীরা তার স্বাভাবিক দৈহিক পরিবর্তন নিয়ে কেন ভয় পাবে? কী কারণে অন্যরা একজন কিশোরীর দৈহিক পরিবর্তন দেখে মন্তব্য করবে? এই ভয়ে সে লুকিয়ে রাখবে নিজের এই পরিবর্তনকে? কারা সেই ভয়ংকর মানুষ, যাদের ভয়ে কিশোরীরা মেরুদণ্ডটি মেলেও হাঁটতে পারে না? বরং এগুলো নিয়েই বইয়ে আলোচনা হতে পারত।

আমরা পারিবারিকভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা দিই। ইংরেজি, বাংলাসহ নানা বিষয়ে শিক্ষা নেওয়ার জন্য ‘চাপাচাপি’ করি। কিন্তু তাদের সঙ্গে নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও পারস্পরিক আচরণ নিয়ে কথা বলতে আমরা খুব স্বচ্ছন্দবোধ করি না। ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়েশিশুর নিরাপত্তা নিয়ে পরিবার চিন্তিত থাকে। এ কারণে ছোটবেলা থেকেই তাকে নিরাপত্তাবলয়ে রাখা হয়। তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সে নিরাপদ নয়। পরিবারের এই মানসিকতারই অনুবাদ দেখা গেছে এ বছরের ষষ্ঠ শ্রেণির গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বইয়ে। ‘কৈশোরকালীন পরিবর্তন ও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা’ বিষয়ক অধ্যায়েই যৌন নিপীড়ন থেকে নিজেকে রক্ষায় কিশোরীদের যেসব উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে, তার কয়েকটি হলো অতিরিক্ত ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া, পরিচিত ও অপরিচিত পরিবেশে একা না যাওয়া, কেউ কাছে ডাকলে কয়েক হাত দূরে থাকা, গায়ে-পিঠে হাত দিতে পারে—এ রকম সুযোগ না দেওয়া।

কিন্তু পাশাপাশি যে কারণে তার এই অনিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়, যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে, সেসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক বা পরিবারে ছেলেদের কোনো ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয় না। এমনকি ছেলেসন্তানটির পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের কারণে কী কী নির্যাতনের পরিসর তৈরি হতে পারে, সেই বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে কোনো ধরনের সচেতনতা সৃষ্টির আগ্রহ নেই। কেন নেই? সেটিই হতে পারে সবচেয়ে জোরালো প্রশ্ন।

পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পাঠ্যপুস্তকে এই একপেশে লিঙ্গীয় সাবধানতার কারণে এই লিঙ্গীয় সম্পর্ক বোঝাপড়ায় কোনো ধরনের মতাদর্শিক নির্দেশনা না নিয়েই আমরা বড় হই। তাই ছোটবেলা থেকেই ‘শান্ত-দুষ্ট’ খেতাব নিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়। আর এই একদা ‘দুষ্ট’ খেতাব পাওয়া ছেলেটিই কখন যে ধীরে ধীরে ধর্ষক হয়ে ওঠে, তা মা–বাবারাও জানতে পারেন না।

পাঠ্যপুস্তকে যৌন হয়রানি আলোচনায় পুরুষ কোথাও নেই। আছে শুধু মেয়েরা এই নিপীড়ন থেকে কীভাবে নিজেকে দূরে রাখতে পারে, সেই
বিষয়ে কিছু সমাজচর্চিত টোটকা। নানা ধরনের যৌন নিপীড়ন নিয়ে নারীকে ছোটবেলা থেকে যে ধরনের তটস্থ থাকতে হয় বা রাখা হয়, সেদিক থেকে ছেলেদের ওপর খুব কমই নজরদারি করা হয়। পরিবারের ছেলেটি কোথায় যাচ্ছে, কখন ফিরবে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে পরিবারের উদাসীনতা সমাজে এখনো আদৃত। ‘ছেলেরা সব সময় ছেলে’ কিংবা ‘ছেলেদের বলে কোনো লাভ নেই’—এটি পুরুষের কোনো বাজে আচরণের অজুহাত হতে পারে না।

পরিবার, সমাজ ও পাঠ্যপুস্তকে যদি লৈঙ্গিক বিষয় নিয়ে অল্প বয়সেই মনোজাগতিক ধাক্কা না দেওয়া যায়, তাহলে আজকে যারা যে রূপে আছে, তারা সেই রূপেই থাকবে। নারী-পুরুষের সমসম্পর্কের যে চর্চা পরিবার থেকে হওয়ার কথা, সেটি হচ্ছে না। পাঠ্যবইয়ে যেভাবে যা উপস্থাপন করার কথা, সেটি হচ্ছে না। পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার সমতার বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকাটা খুবই দরকার।

 নারীকে নির্যাতন না করার বিষয়ে এবং নারীকে কুঁজো করে দেওয়া নয় বরং নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেদের আচরণ কী হওয়া উচিত, সেই বিষয়েই পাঠ্যবইয়ে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ছেলেরা কীভাবে কাজ করবে, সেই বিষয়েই নির্দেশাবলি দেওয়া দরকার ছিল। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার আলোচনায় শুধু নারীকে টার্গেট করলে হবে না; সব ক্ষেত্রে এই ধরনের আলোচনায় রাখতে হবে পুরুষকেও।

জোবাইদা নাসরীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]