চীনের বাস্তবতাকে যুক্তরাষ্ট্রের মেনে নিতে হবে

বুয়েনস এইরেসে গত ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একটি সমঝোতা চুক্তিতে সই করার পর স্বাভাবিকভাবে অনেকের মনে হয়েছে যে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের শিগগিরই অবসান হতে যাচ্ছে। তবে তাঁরা ভুল ভেবেছিলেন। বরং দুই দেশের শীতল সম্পর্কের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ডিসেম্বরের গোড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মেং ওয়ানঝুকে কানাডায় গ্রেপ্তারের ঘটনার পর কোনো সন্দেহ নেই যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্য বিপর্যয়টা সম্ভবত ঘটবে না যদি যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতাকে মোকাবিলা করার জন্য তিনটি উপায় বেছে নেয়।

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিপ্রণেতাদের চীনের পরিবর্তিত অবস্থানকে মেনে নিতে হবে। চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় জিডিপির দেশ হিসেবে অহংকার করে। ২০ শতকে যুক্তরাষ্ট্র যেমন সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, তেমনি একুশ শতকে চীন হবে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ। কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রই বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে থাকবে।

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হবে, যা চার দশক আগে চীন করেছিল। বাণিজ্য ঘাটতির জন্য অন্য দেশকে দায়ী না করে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এ জন্য নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি, অবনতিশীল বাণিজ্যিক সক্ষমতা এবং অবকাঠামো নির্মাণে, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগকে দায়ী করা। যদি মার্কিন নীতিপ্রণেতারা ওয়াল স্ট্রিট, বড় ব্যবসা এবং নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতিবিদদের খুশি করার ওপর জোর দেন, তা হলে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এবং আমেরিকানদের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য ক্রমেই বাড়তে থাকবে। আর এটা সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও চরমপন্থা বাড়ার ঝুঁকি তৈরি করবে। সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে হবে। এসব ক্ষেত্রে ভুল মূল্যায়ন অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

চীন কখনো ভৌগোলিক সম্প্রসারণের জন্য আগ্রাসী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, এমনকি যখন তাদের তা করার ক্ষমতা ছিল, তখনো তারা করেনি। এটি চীনের সম্রাটদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রীয় শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা ডক্ট্রিন অব মিইন নামে পরিচিত। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা সব সময় ধ্বংস ডেকে আনে এবং জনগণের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে।

এ ছাড়া চীন অন্য দেশের সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা কোনো দূর অতীতের ঘটনা নয় এবং একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হোক, এমনটা তারা চায় না। চীন সম্প্রতি তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা গড়ে তোলার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থেকেছে। চীন যা চায় তা হলো, একটি ন্যায্য ও উন্মুক্ত বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে সবাই সমানভাবে অংশ নিতে পারবে এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করবে। চীন তার জনগণের অব্যাহত কল্যাণ চায় এবং বিশ্বাস করে যে বিশ্বে শান্তি তখনই দীর্ঘস্থায়ী হবে, যখন সব দেশ অর্থনৈতিকভাবে সফল হবে।

কিন্তু চীনের নেতাদের দেশের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ বজায় রাখার জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যদিও দেশীয় সংস্থাগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু উৎপাদন খাতে প্রতিযোগিতা করছে, তবে কিছু অত্যাধুনিক পণ্যের জন্য তারা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। যেমন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে তারা চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির নিয়ম লঙ্ঘন করার পর চীনের টেলিকম কোম্পানি জেটিইর কাছে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ বিক্রির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় চীনের প্রযুক্তিগত অপর্যাপ্ততার বিষয়টি স্পষ্ট করেছে। তার ওপর চীনকে এখন তার বিপুল জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশটিকে একটি বয়স্ক সমাজের বোঝাও বহন করতে হবে।

এমন পরীক্ষিত সময়ে চীনের ওপর কোনো ধরনের যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়াটা কারও কোনো উপকার করবে না। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একটি বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে একটি নতুন বহুজাতিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তারা পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে সব চ্যালেঞ্জ যৌথভাবে মোকাবিলা করে সবচেয়ে কার্যকরভাবে এটা করবে। যুক্তরাষ্ট্রকে এটা বুঝতে হবে যে চীনকে অর্থনৈতিকভাবে পরাজিত করার চেষ্টা করলে, তা তার দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা দূর করবে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

পি এইচ ইয়ু পিকিং ইউনিভার্সিটির কাউন্সিল অব দ্য ইনস্টিটিউট অব নিউ স্ট্রাকচারাল ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান