বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্ব নেই কেন

একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। ইশতেহারের ‘১. আমাদের বিশেষ অঙ্গীকার’ শিরোনামের ঠিক নিচেই ১৯ দফায় শিক্ষা তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রায় সব দফা থাকলেও বিজ্ঞানের কোনো কথা স্পষ্টভাবে দেখতে পাইনি। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি হতাশ হয়েছি মানবসভ্যতার ইতিহাসের এই দিকটাকে প্রায় অনুল্লেখ রাখার কারণে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও বিজ্ঞান গবেষণাকে কোনো একটি মেগা প্রজেক্ট হিসেবে গণ্য করা হলো না। এটা আওয়ামী লীগের থিংকট্যাংকের সম্মানিত সদস্যদের কাছে আমার প্রশ্ন। প্রশ্নটি থাকল প্রধানমন্ত্রীর কাছেও।

এ প্রসঙ্গে আমরা প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকালে দেখতে পাই, গেল শতকের তিরিশের দশকে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসী যখন ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার আন্দোলনে উত্তাল, পরাধীন দেশটির চিন্তাশীল ব্যক্তিরা—যাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ—স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার রূপরেখা তৈরিতে ব্যস্ত। আগামী দিনের ভারতের সার্বিক উন্নয়নে বিজ্ঞান গবেষণার ভূমিকা, এর ব্যাপ্তি ও প্রয়োগের কথা মাথায় রেখে তাঁরা এক সুদূরপ্রসারী রূপকল্প তৈরি করেছিলেন।

আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে ভারত পারমাণবিক শক্তি কমিশন গঠন করে; আজ দেশটি তার ফল পাচ্ছে পরমাণুসংশ্লিষ্ট প্রায় সব ক্ষেত্রেই। প্রায় একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে পরামর্শ দেওয়া হলো স্বাধীন ভারতের উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার লক্ষ্যে উচ্চমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য। দেশের নামকরা গবেষক ও পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বিশেষ অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ১৯৫০ সালে খড়গপুরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) নামে প্রথম বিশ্বমানের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। ১৯৫১ সালের ১৮ আগস্ট মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটির দ্বার উন্মোচন করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে মুম্বাই, কানপুর, মাদ্রাজ ও দিল্লিতে তৈরি করা হলো দেশটির আরও চারটি আইআইটি। খড়গপুরে ভারতের প্রথম আইআইটির কনভোকেশনে প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেছিলেন, ‘আজ খড়গপুরে আগামী দিনের ভারতকে এগিয়ে নেওয়ার এক যাত্রা শুরু হলো। এই পথ ধরেই আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভারতের উন্নয়নের ধারা এগিয়ে যাবে।’

 এরপর একে একে গড়ে উঠেছে মোট ২৩টি আইআইটি, যা সারা বিশ্বে বিজ্ঞান প্রসারে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণায় প্রধান পদগুলোর অনেকগুলোতেই রয়েছেন আইআইটির স্নাতকেরা। বছর কয়েক আগে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ভারতে এসে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা এগিয়ে আছি যোগাযোগপ্রযুক্তির হার্ডওয়্যার তৈরিতে আর ভারত এগিয়ে আছে সফটওয়্যার তৈরিতে। আসুন, প্রযুক্তির এই দুই ধারাকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করি।’

এবার আমাদের নিজেদের কথায় আসি। অনেকেই বলেন ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ভারতের আইআইটির আদলে যদি বিআইটির (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) রূপরেখা তৈরি করে যেতেন, তবে আমাদের দেশেও গড়ে উঠত বিশ্বমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক ধারা। কিন্তু আমাদের একটি বিষয় বুঝতে হবে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল। কাজেই ভারতের পক্ষে আগামী দিনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কথা চিন্তা করা খুব একটা কঠিন ছিল না। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অবস্থা এমনটি ছিল না। ফলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ভবিষ্যতের চেয়ে দেশের মানুষের দুবেলা খাবার মেটানোকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছিল। কিন্তু ৪৭ বছর পরও কেন আমরা ভারতের আদলে আমাদের মেধা ও পরিকল্পনা দিয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি) অথবা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিআইএসটি) নামে বিশ্বমানের অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারব না?

 এ ব্যাপারে সরকারের বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাই:

অচিরেই সংসদে ‘উচ্চতর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক অধ্যাদেশ’ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে: (ক) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিআইপিএসটি) ও(খ) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (বিআইবিএসটি) তৈরির উদ্যোগ নেওয়া। প্রথম পর্যায়ে দুটোর কার্যক্রম সীমিত থাকবে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ের পাঠদান ও উচ্চতর গবেষণার মধ্যে।

(ক) বিআইপিএসটির কার্যক্রমের বিজ্ঞান অনুষদে থাকবে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, গণিত, পরিসংখ্যান ও ভূবিদ্যা। আর প্রযুক্তি অনুষদে থাকবে কম্পিউটার ও আইটি, মাইক্রো ইলেকট্রনিকস, মেকাট্রনিকস, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও খনিজ, রসায়নশিল্প ও মানব পরিসংখ্যান।

(খ) বিআইবিএসটির কার্যক্রমের বিজ্ঞান অনুষদে থাকবে প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন ও তত্ত্বীয় বায়োট্রনিকসের মতো প্রায়োগিক বিজ্ঞান। আর এর প্রযুক্তি অনুষদে থাকবে বায়োটেকনোলজি, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, পুষ্টিবিদ্যার মতো সরাসরি প্রযুক্তির বিষয়গুলো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উল্লিখিত বিষয়গুলোর ওপরে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষাদান ও গবেষণা হবে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষক ও গবেষকদের দ্বারা। পিএইচডি ডিগ্রি হবে শিক্ষক ও গবেষকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা।

ঢাকায় অবস্থিত ‘বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, তার কার্যক্রম আমাদের জানা নেই; কালক্রমে এটি একটি অনুৎপাদনশীল সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের নামমাত্র প্রতিষ্ঠানের জন্য কেন জনগণ অর্থ দেবে? এর পরিবর্তে ব্রিটেন অথবা ভারতের আদলে বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসইআইআর) নামে একটি বিভাগ চালু করতে পারলে আগামী দুই দশকে বাংলাদেশের বিজ্ঞান গবেষণার মান বিশ্বমানে পৌঁছাতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ৭০ বছর আগে ভারত যা করতে পেরেছে, আজ আমরা সেটা পারব না কেন?

আওয়ামী লীগের ইশতেহার প্রণয়নকারীরা বলতে পারেন, প্রস্তাবিত বিআইটির কাজকর্ম তো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই হয়ে থাকে। হয়তোবা কিছুটা হয়; কিন্তু সে ধরনের কাজ বেশির ভাগই হয়ে থাকে একান্তই ব্যক্তি উদ্যোগে, সমষ্টিগতভাবে অথবা সুসমন্বিতভাবে হয় না। এতে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে বিশেষ কোনো প্রভাব পড়ে বলে মনে করি না।

তাই আগামী দুই দশকে ভারতের আইআইটিগুলোর আদলে যদি বাংলাদেশে সমন্বিত বিজ্ঞানের উন্নয়ন তথা দেশের উন্নয়ন আমরা দেখতে চাই, তবে বিআইএসটির কোনো বিকল্প নেই। কাজেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাবটি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাই।

এস এম মুজিবুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, বর্তমানে ওমানের কাবুস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় িনয়োজিত