ইমরান খান কি কঠোর হবেন

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এখন খুব জটিল অবস্থার মধ্যে আছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তাঁকে একজন গ্রেড-২১ কর্মকর্তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যিনি একটি হাই প্রোফাইল মানব পাচারের মামলায় দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফআইএর আসামির তালিকায় রয়েছেন।

ওই কর্মকর্তা এফআইএর প্রতিদ্বন্দ্বী একটি সংস্থায় কর্মরত। এই উভয় সংস্থাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন, যার দায়িত্বে রয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ইদানীং ওই কর্মকর্তাকে নিয়ে এই দুটি সংস্থার মধ্যে বিবাদ হচ্ছিল। ওই কর্মকর্তা আগে এফআইএতে কাজ করতেন এবং তাঁর পদোন্নতিও হয়েছিল। অনেকেই এই ভেবে বিস্মিত যে এফআইএ খুঁজছে, এমন একজন কর্মকর্তাকে কেন পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল?

মানব পাচার হচ্ছে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। প্রথম আফগান যুদ্ধের (যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করেছিল) পর পাকিস্তান থেকে আকাশ, সাগর ও স্থলপথে ব্যাপক মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি গোপন নথিতে দুটি তদন্ত ও গোয়েন্দা সংস্থার কমপক্ষে চারজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে, যাঁরা কিনা করাচি বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওই নথির একটি কপি আমার কাছে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নথিতে নাম থাকার পরও ওই কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কোনো তদন্ত হয়নি।

এখন ইসলামাবাদের বেনজির ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট দিয়ে প্রচুর মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। গত চার বছরে ১০ হাজারের বেশি মানুষ জাল পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে পাকিস্তানের বাইরে গেছেন। পাচারকারীরা বিমানবন্দরের অভিবাসন কর্মকর্তা এবং এফআইএর কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় মানব পাচার করছেন। ইসলামাবাদে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশন একবার পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে লন্ডনের একটি বিমানবন্দরের ডাস্টবিন থেকে বেশ কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়া পাকিস্তানি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। পরে এ ঘটনার তদন্তের ফলাফলে জানা গেছে, এই যাত্রীরা পিআইএর একটি ফ্লাইটে করে ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনে গিয়েছিলেন।

তবে পাকিস্তান এই সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছে এবং মানব পাচার রোধে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সতর্কতা অবলম্বন করে এবং পাকিস্তান থেকে আসা ফ্লাইটগুলোর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যই তারা একজন পাকিস্তানি এবং কয়েকজন আফগান নাগরিককে তাদের পাসপোর্ট বিমানবন্দরের ডাস্টবিনে ফেলার সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

যুক্তরাজ্য আবারও এ ব্যাপারে পাকিস্তানকে সতর্ক করে। তারা এমনকি একজন গুরুত্বপূর্ণ পাচারকারীকে গ্রেপ্তারও করে, যিনি মানব পাচারের জন্য প্রায়ই পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে ভ্রমণ করতেন। যুক্তরাজ্যের একটি আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং চার বছরের কারাদণ্ড দেন। একজন জ্যেষ্ঠ তদন্তকারী আমাকে বলেছেন, বেশির ভাগ পাচারকারী জাল পাসপোর্ট ও ভিসা নিয়ে প্রায়ই যুক্তরাজ্য বা স্পেনে যান। এক তদন্তে দেখা গেছে, যাঁরা জাল পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করেন, তাঁরা খুব সহজেই ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে যান। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে তাঁদের সাহায্য করেন।

যুক্তরাজ্যের চাপের মুখে ২০১৭ সালে এফআইএর নতুন কমান্ড মানব পাচারের ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তের সময় তদন্তকারী কর্মকর্তারা দেখেছেন, একজন মানব পাচারকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এফআইএর একজন পরিদর্শকের অ্যাকাউন্টে গেছে। তদন্ত কর্মকর্তারা আরও দেখতে পেয়েছেন যে কিছু এফআইএ কর্মকর্তার সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিমানের টিকিট পেয়েছেন। তদন্তের সঙ্গে জড়িত একজন জ্যেষ্ঠ এফআইএ কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, মানব পাচারের মূল হোতাকে এখন গ্রেপ্তার করা দরকার, কিন্তু তিনি বেশ ক্ষমতাবান। তাঁকে গ্রেপ্তারের আহ্বানসংবলিত ফাইলটি এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

আরেকটি সূত্র আমাকে জানিয়েছে যে একটি লবি গোষ্ঠী এই তদন্তের প্রকৃতি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্য বন্দী বিনিময় এবং অর্থ পাচার ও মানব পাচারের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু পাকিস্তান এ ব্যাপারে আসলে কোনো সহযোগিতাই করছে না।

যুক্তরাজ্যের বারবার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও পাকিস্তান মানব পাচার রোধে সে অর্থে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখন মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত এফআইএর সাবেক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে। এটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য বড় ধরনের একটি পরীক্ষাই বটে। অর্থ পাচার ও মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ দমনের ব্যাপারে তাঁর সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এখন তিনি সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন কি না, তা দেখার অপেক্ষা।

জিও নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মাজহার আব্বাস সিনিয়র কলামিস্ট ও জিও নিউজের বিশ্লেষক