কিমের সঙ্গে ট্রাম্পের দ্বিতীয় বৈঠক কী ফল দেবে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং-উন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কিম জং-উন।

আগামী মাসে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আবার বৈঠক করবেন, তখন তিনি কোরীয় উপদ্বীপ বিষয়ে চলমান মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কমেডি চরিত্রে অভিনয় করবেন। আর এই নাটকের পাণ্ডুলিপিটি অস্কার ওয়াইল্ড লিখতে পারেন। যেকোনো ড্রয়িংরুমের হাস্যরসাত্মক নাটকের মতো এই নাটকের কাহিনিও হবে খুব সাধারণ। কিম কোনো একদিন তাঁর পারমাণবিক অস্ত্র পরিত্যাগ করার অঙ্গীকার করবেন। তবে পরমাণু কর্মসূচির সব তথ্য খুব কৌশল করে গোপন রাখবেন এবং ট্রাম্প কিম বংশের ধনসম্পদ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেবেন।

তবে অবশ্যই এই নাটক কমেডির চেয়ে অনেক বেশি বিয়োগান্ত হবে। গত বছর সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ট্রাম্প ও কিমের মধ্যকার প্রথম বৈঠকের ফল দেখে এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিম জং–উনের ফাঁকা প্রতিশ্রুতি ট্রাম্প সরল মনে মেনে নেওয়ার ফলে গত আট মাসে কোনো কিছুই হয়নি, বরং দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য স্থানে মার্কিন প্রভাবের বিষয়টি অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। উত্তর কোরিয়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের কর্মসূচি চালিয়ে গেছে এবং তার শাসনের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা অনেকখানি দুর্বল করতে সমর্থ হয়েছে।

ট্রাম্প শুধু যে কিমের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষা থামাতে ব্যর্থ হয়েছেন তা নয়, তিনি এশিয়ায় প্রতিরোধক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও খর্ব করেছেন। উত্তর কোরিয়ার প্রচলিত অস্ত্রভান্ডার ইতিমধ্যে জাপান এবং মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে এমন সব দেশের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্য দেশ থেকে মার্কিন সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে ট্রাম্পের প্রকাশ্য ঘোষণা মৌলিকভাবে তাঁর আঞ্চলিক কৌশলগত হিসেবে পরিবর্তন এনেছে। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে হয়তো টোকিও, সিউল, তাইপে এবং দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার নেতারা তাঁদের মনোভাব গোপন রাখবেন বা সুস্পষ্টভাবে উত্তর দেওয়া এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এটা সত্য যে ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা অঙ্গীকারের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন, তখন উত্তর কোরিয়া ও চীন তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করছে।

এ সমস্যা অন্যান্য মার্কিন নীতিপ্রণেতার মনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এ কারণে যখনই ট্রাম্প বিদেশ সফর করেন, তখন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একটি দল নিয়ে আলোচনা করেন। তবে তাঁদের আলোচনা কতটা কার্যকর, তা কোনো বিষয় নয়। আসলে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতার যে ক্ষতি করেছেন, তার পূরণ তাঁরা কোনো দিনই করতে পারবেন না। গত জুনে ট্রাম্পের দেওয়া ঘোষণাটির কথা মনে করুন। তিনি বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়া ‘আর পারমাণবিক হুমকি নয়।’ এটি অবশ্যই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী জাপানের কাছে একটি খবর। এমনকি কিমের প্রশাসন আন্তমহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা যদি পরিত্যাগ করতে সম্মত হয়ও তারপরও উত্তর কোরিয়ার হাজার হাজার পারমাণবিক-সক্ষম ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র জাপানের দিকে তাক করে রয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর কোরিয়ার প্রচলিত অস্ত্রগুলোর হুমকিকেও উপেক্ষা করছে। দক্ষিণ  কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক মহড়া বন্ধ রাখার জন্য ট্রাম্পের একতরফা সিদ্ধান্তই তার প্রমাণ। অথচ যুদ্ধের পরিকল্পনা পরিমার্জনের জন্য এবং সামরিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক মহড়া অব্যাহত রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কোরীয় উপদ্বীপে যেকোনো অঘটন মোকাবিলার পাশাপাশি জাপানের প্রতিরক্ষার জন্যও যৌথ সামরিক মহাড়াটা খুব দরকার ছিল।

আগামী মাসে কিমের সঙ্গে ট্রাম্পের পরবর্তী বৈঠকে যা–ই ঘটুক না কেন, এটা ইতিমধ্যে পরিষ্কার যে মার্কিন মিত্রদের অগ্রাহ্য করে ট্রাম্প তাঁর নিজের ক্ষতি করেছেন। মিত্রদের মধ্যে যদি অসন্তোষ থাকে, তাহলে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে। উদাহরণস্বরূপ, তিন বছর আগে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবু আজ জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণ পুনর্বিবেচনার বিষয়ে আবারও উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

এরই জেরে গত মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যুদ্ধজাহাজ জাপানের একটি টহল বিমানকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল। মার্কিন মধ্যস্থতার অনুপস্থিতিতে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতার সম্ভাবনা মনে হয় হ্রাস পাচ্ছে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে–ইনের সরকারকে উত্তর কোরিয়া ও চীনের আরও কাছে নিয়ে আসছে।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ড্যানিয়েল স্নেইডার বলেছেন, কোরীয় উপদ্বীপ এলাকা থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাবনার বিষয়টি জাপানের অনেকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে শুরু করেছে এবং জাপানি নেতারা তাঁদের দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতির বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি এশিয়া রিঅ্যাশিওরেন্স ইনিশিয়েটিভ অ্যাক্ট (আরিয়া) নামের একটি প্রকল্পকে আইনে পরিণত করেছেন। ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে আগামী পাঁচ বছর এশিয়ায় সক্রিয় থাকা। বিশেষ করে উত্তর ও উত্তর–পূর্ব এশিয়ায় তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা। এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি ফিরিয়ে আনে, সেটা এখন দেখার বিষয়।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

কেন্ট হ্যারিংটন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার সাবেক বিশ্লেষক

জন ওয়ালকট জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ফরেন সার্ভিসের অধ্যাপক