নদী বাঁচানোর নতুন রায়

নদী বাঁচাতে কতিপয় নির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ আরও একটি উল্লেখযোগ্য রায় দিয়েছেন। এর আগে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক একটি বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যার বেশির ভাগই আমরা বাস্তবে কার্যকর হতে দেখিনি।

নদী হলো বিশ্বমানবতার সম্পদ। আড়াই হাজার বছর আগের জাস্টিনিয়ান কোড তাই বলেছিল, নদী, জলাশয়, বায়ু এসব হলো অহস্তান্তরযোগ্য সম্পদ, যা সর্বদাই রাষ্ট্রের। এর ওপর কোনো ব্যক্তির মালিকানা কায়েম হতে পারে না। কারণ, কোনো ধরনের বিক্রি, ইজারা, বন্ধক বা অন্য কিছু দ্বারা এসবের ওপর জনগণের সর্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ এখতিয়ার খর্ব করা যাবে না। বাস্তবে আমরা যত নদী দখল দেখি, সেখানে অনেকেই এর সপক্ষে ‘বৈধ দলিলপত্র’ প্রদর্শন করতে পারেন। অনেক সরকারি কর্তৃপক্ষ জেনে বা না জেনে কখনো নদীর দখল বুঝিয়ে দেয়। এটা তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালুসহ অনেক নদী এলাকার জমির বিলিবণ্টনের ক্ষেত্রেই সত্য।

নদী যে একটি বিশেষ প্রাকৃতিক সম্পদ, বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে এই বিষয়ে যথেষ্ট অজ্ঞতা এবং অসচেতনতা লক্ষ করা যায়। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এবং ইংল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট বহুকাল আগেই উক্ত জাস্টিনিয়ান কোডের ভিত্তিতে নদীসংক্রান্ত অনেক ‘বৈধ কাগজপত্র’ বাতিল করে নদী দখলকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নদী দখলকারী মন্ত্রীদের জরিমানা করে সেই রায় সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশে যেভাবে ব্যাপক ভিত্তিতে নদী দখল ও নদীদূষণ চলছে, তাতে দখল বা দূষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এটা দুঃখজনক যে নদী বা জলাশয় সুরক্ষায় সরকার বা সংসদগুলোর তেমন কোনো সংবেদনশীলতা দেখা যায় না।

তবে বিলম্বে হলেও হাইকোর্টের কতিপয় নতুন নির্দেশনার ভিত্তিতে আমরা নতুন সংসদ ও সরকারের কাছে একটা জাগরণ আশা করতে পারি। হাইকোর্ট নদী দখলকারীদের সব ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ব্যাংকঋণ পেতে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। এখন বড় প্রশ্ন দাঁড়াবে নদী দখলকারী কে বা কারা? এই রকম তালিকা তৈরির উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কে হবে? ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে আমরা বৈষম্য দেখেছি। আমরা আশা করব, নদী দখলকারীরা যাতে সত্যিই শাস্তির অংশ হিসেবে কিছু অধিকার ভোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আদালতের নির্দেশনায় অনেকগুলো নতুন বিষয় এসেছে, যা জাতীয় সংসদে বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার।

আদালত তুরাগ নদকে লিগ্যাল পারসন ও জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই ধারণা বাংলাদেশেই যে প্রথম তাই নয়, এটা বিশ্বেও বিরল। ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের সংসদ বিশ্ব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের একটি নদীকে লিগ্যাল পারসন ঘোষণা করেছিল। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে এর আগে শুধু সুপারিশ প্রদানকারী সংস্থার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তারা ঠুঁটো জগন্নাথ। তাদের সুপারিশ বাস্তবে কাগজে–কলমেই পড়ে থাকে। আদালত এবার তাদেরই একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এটা বাস্তবে রূপ নেবে না বলেই আমাদের আশঙ্কা।

হাইকোর্টের দুটি নির্দেশনার আলোকে আমরা অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপের বাস্তবায়নকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ঢাকার চারটি নদীর মধ্যে এ পর্যন্ত কেবল বুড়িগঙ্গার সীমানা চিহ্নিতকরণ, খুঁটি স্থাপন এবং হাঁটার পথ তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। বাকি তিনটি নদীরই এসব কাজ বহুলাংশে বাকি। নদী খননের অগ্রগতিও হতাশাব্যঞ্জক। আপাতত সবার আগে সীমানা নির্ধারণী খুঁটি স্থাপনকাজ শেষ হোক। কারণ, এই একটি কাজই দখলকারীদের রুখতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।