বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া

দুর্নীতির বিরুদ্ধে শোরগোল শুরু হয়েছে। তাতে কোমলমতি পাঠকের মনে হতে পারে যে এই অদৃশ্য অপশক্তি দেশ থেকে পালাল বলে। কারণ তাকে আর সরকার বিন্দুমাত্র টলারেট বা সহ্য করবে না। অবশ্য যারা সব ব্যাপারেই সন্দেহবাদী, তারা যথার্থভাবেই মনে করছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিহাদ ঘোষণার কথা শোনা যাচ্ছে তা শূন্যে গদা ঘোরানো মাত্র। দুর্নীতি নির্মূলের যে তোড়জোড়, তাকে ভারতবর্ষের মুনিঋষিদের ভাষায় বলা যায় বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া।

বিষয়টি এমন নয় যে যাঁরা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাঁরা এখন অফিস থেকে বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীকে বলবেন, আব্বা-আম্মাকে (শ্বশুর-শাশুড়ি) গিয়া বলো নতুন যে দুটি ফ্ল্যাট ওনাদের নামে বায়না করেছি তা আর কেনা হবে না। কারণ, এখন থেকে আমার দুর্নীতি করা বন্ধ। বায়নার টাকাটা ফেরত পেলে হয়। অথবা বলবেন, আমেরিকায় ঝন্টুকে (স্ত্রীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা) বলে দিয়ো ওর মাধ্যমে সেখানে যে ডলারগুলো জমা হয়েছে তা যেন ঠিকঠাক থাকে। এখন থেকে দুর্নীতি করে রোজগার করা সম্ভব হবে না। সরকার আর করাপশন করতে দেবে না।

বাঙালি কবি-সাহিত্যিকই যে শুধু উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেন তা নয়, রাজনৈতিক নেতারাও উপমা দিয়ে বক্তব্য দিতে ভালোবাসেন। তাঁরা অনেকেই সততার পরাকাষ্ঠা ও নীতিমান মানুষ। তাঁদের ভাষায় দুর্নীতি একটি মারাত্মক ব্যাধি। যেকোনো রোগের উপশমের উপায় দুটি: প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা এবং রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে ডাক্তার-কবিরাজের ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি কলেরা ও গুটিবসন্তে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। চিকিৎসায় পাঁচ ভাগও নিরাময় করা যেত না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রতিষেধকমূলক টিকা ও ইনজেকশন দেওয়ার পর এখন ওই রোগ দুটি নেই বললেই চলে। প্রতিষেধক ছাড়া শুধু চিকিৎসা দ্বারা কলেরা-বসন্ত নির্মূল সম্ভব হতো না। দুর্নীতি ব্যাধিটি ওই দুই রোগের চেয়ে খুব যে কম ক্ষতিকর, তা নয়।

লজিক ও দর্শনশাস্ত্র বলে কারণ ছাড়া কোনো কার্যই হয় না। সব কাজের পেছনে একটা কারণ থাকে। দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্স বলার আগে কী কারণে দুর্নীতির ব্যাপকতা, তার কারণ অনুসন্ধান করাই বুদ্ধিমানের কাজ। সে জন্যই ধারণা করি ভারত স্বাধীনতা লাভের পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দুর্নীতি বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন, যার প্রথম কাজটি ছিল গবেষণা করা ‘হোয়াট ইজ দ্য কজেস অব করাপশন’—দুর্নীতির কারণ কী? অসামান্য সুলিখিত মেধাবী গবেষণা। অতসব করার পরেও উপমহাদেশের সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল সম্ভব হয়নি।

কুড়ি শতকের শেষ এবং বর্তমান শতকের প্রথম কয়েক বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিতে দুনিয়ায় প্রথম স্থান অধিকার করে। ওই সময় দুই সরকারের দুই বিরোধী দল সরকারের দিকে আঙুল তাক করে খুশিতে বগল বাজাতে থাকে। দেশের বদনামে আমার ভালো লাগেনি বলে ওই জরিপ সম্পর্কে আমি ভিন্নমত
পোষণ করেছিলাম। দুর্নীতি যেহেতু কোনো বস্তু নয়, তাই তা নিক্তি দিয়ে পরিমাপেরও জিনিস নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল থেকে ঠিকই বলা হয়েছে এই ধরনের জরিপ ‘ধারণার প্রতিফলন’ মাত্র। তবে সে ধারণা বাস্তবসম্মত।

দুর্নীতি নিয়ে গবেষকেরা সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। একেক বছর বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রোল নম্বর একেক রকম হয়, যেমন ২০১৮ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৩তম। এতে আমাদের আনন্দিত হওয়ার বিষয় এইটুকু যে আমাদের চেয়েও দুর্নীতিবাজ দেশ আরও ১২টি রয়েছে। অনেকে সান্ত্বনা পেতে চান এই বলে যে অর্থনীতি বড় হলে, বিরাট আকারের বাজেট হলে, বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে বিপুল অনুদান ও ঋণ পাওয়া গেলে বড় রকমের দুর্নীতি হতেই পারে।

যখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন–ভাতা দ্বিগুণ করা হলো, তখন বলা হলো ‘এবার দুর্নীতি কমবে’। তার অর্থ দাঁড়ায় আর্থিক অনটনের জন্যই বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। অর্থাৎ বাঙালির সেই প্রাচীন প্রবচনই সত্য: অভাবে স্বভাব নষ্ট। ওই তত্ত্ব যখন দেওয়া হয়, তখন আমি এক বড় কর্তাকে বলেছিলাম, অভাব–অনটনের কারণেই যদি মানুষ ঘুষ-দুর্নীতি, চুরিচামারি করে থাকে, তাহলে সবচেয়ে গরিব যে ২০ শতাংশ মানুষ তারাই শুধু দুর্নীতি করত। দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত ও বিত্তবান যে ২০ শতাংশ তারা দুর্নীতির ধারেকাছে যেত না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত, ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরা।

নীতিকথা সব জায়গায় খাটে না। উপদেশ সবাইকে দেওয়া যায় না। যে ছেলে বা মেয়েটি জমিজমা বিক্রি করে ১০–১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছে, তাকে যদি আমি গিয়ে বলি, ‘বাবা বা মা, তুমি চাকরিতে গিয়ে কোনো রকম দুর্নীতি কোরো না। ঘুষ খাওয়া বা অবৈধ উপায়ে উপার্জন খুব খারাপ কাজ।’ এই কথা শুনে শ্রোতা যদি আমার দিকে বড় বড় চোখে কটমট করে তাকিয়ে বলে, ‘কয় কী লোকটা! পাগল নাকি?’ ওকে খারাপ বলব কোন আক্কেলে!

ইংরেজ শাসনামলে এই উপমহাদেশে দুর্নীতি শুরু হয়েছে কলাটা–মুলাটা উপঢৌকন দেওয়ার মাধ্যমে। ট্রেনের টিটি যাত্রীদের টিকিট চেক করতে গিয়ে কখনো দু-এক টাকা নিতেন। তাকেই লোকে খুব খারাপ বলত। মার্ডার কেসগুলো থেকে থানার বড় দারোগা বা সেকেন্ড অফিসার কিছু খেতেন। পুলিশ সুপারকে ঘুষ দেওয়ার কেউ সাহসই পেত না। তিনি নিজেও মনে করতেন কাজটি বড়ই অসম্মানের। বর্তমানে অবৈধ উপার্জনের ক্ষেত্র বিশাল। লেনদেন শত শত কোটি টাকা বা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ঘুষ, কমিশন, কর ফাঁকি, ভ্যাট ফাঁকি, চাঁদা আদায়, ইয়াবা ব্যবসা, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি—হাজারো উপায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘দুর্নীতির মহাসমুদ্রে কাকে ধরব?’ দুর্নীতির সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ব্যক্তিগত দুর্নীতি এক রকম। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। স্বাধীনতার আগে শুনেছি এজি অফিসের চেয়ার-টেবিলও ঘুষ খায়। কিন্তু তার পরিমাণ কত? তারা ঘুষ খেয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে পাঁচ–সাত হাজার টাকা দিয়ে এক টুকরো জমি কিনেছেন অথবা গ্রামে কিছু জমিজমা করেছেন। এখনকার অবস্থা ৫০ বছর আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত আবজাল-সিনড্রোম। সে কী সম্পদ রে বাবা!

অবৈধভাবে অর্জিত অপরিমেয় অর্থ বৈধভাবে দেশে রাখার ব্যবস্থা নেই। বৈধ পন্থায় ডলারও বিদেশে পাঠানো যায় না। ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ওপর নজরদারির ব্যবস্থা আছে। মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন আছে। তাহলে অবৈধ টাকা বিদেশে যাচ্ছে কী উপায়ে? গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) অবৈধ অর্থ পাচারের তথ্য দিয়েছে। ২০১৪-এর নির্বাচনের পরে টাকাওয়ালারা মনে করেছিলেন দেশে থাকা যাবে না। ২০১৫-তে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৫৯০ কোটি ডলার বা ৫০ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে টাকা পাচারের দিক থেকে সে বছর বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে ১৯তম। ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ২২ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। টাকা পাচারকারীদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিকরনেওয়ালা, ভোটারবিহীন জনপ্রতিনিধি এবং অসাধু শিল্পপতি-ব্যবসায়ী।

জগতের কিছু গুরুতর বিষয় মালকোচা মেরে সমাধান করা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন কঠোর কর্মকৌশল, সুষ্ঠু পরিকল্পনা। দুর্নীতির মহাসমুদ্র থেকে পাঁচ–দশজনকে পাকড়াও করে কিছু হবে না। শ্রীঘরে পাঠানোর সঙ্গে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। তবে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন বা সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক