সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে ভাবতে হবে

১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রথম বাংলাদেশের সংসদে সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা চালু করা হয়, যেখানে ৩০০টি সাধারণ আসনের সঙ্গে নারীদের জন্য ১০ বছরের জন্য অতিরিক্ত ১৫টি সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০টি, এরপর ৪৫টি এবং ২০১১ সালের ১৫তম সংশোধনীতে এর সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়। তবে ১০ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০১৮ সালের ৮ জুলাই ১৭তম সংশোধনীতে আসনসংখ্যা ২৫ বছরের জন্য বাড়িয়ে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়।

‘সংরক্ষিত আসনের’ দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে আছেন, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থার অধীনে এনে তাঁদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করা। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০১৮ সালে এসেও আমরা সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা এবং এর মেয়াদ বাড়াতে দেখছি। আশা করা হয়েছিল, সংরক্ষিত আসনে আসা নারীরা একবার-দুবার এভাবে এসে, সংসদীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে, পরে সরাসরি নির্বাচনে যাবেন এবং রাজনীতিতে নিজেদের জায়গা করে নেবেন। বাস্তবে তা কিন্তু হয়নি। এ কারণে আমার প্রতীতি, সংরক্ষিত আসনের চেতনাটাই মার খাচ্ছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থার মূল দুর্বলতা হলো: সাধারণ আসনের প্রার্থীদের মতো সংরক্ষিত আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নিজেদের কোনো এলাকা থাকে না, যার হয়ে তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। ফলে সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীদের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রার্থীদের মতো ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগও থাকে না। জনপ্রতিনিধিত্বের সুযোগ না থাকায় সংরক্ষিত আসনের প্রার্থীরা সাধারণ আসনে নির্বাচন করা প্রার্থীদের মতো নিজেদের জন্য তহবিলও সংগ্রহ করতে পারেন না, যা তাঁদের অবস্থাকে আরও দুর্বল করাসহ প্রকৃতপক্ষে তাঁদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ সাংসদে পরিণত করে।

সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছে, যেখানে শুধু আলাদাভাবে নারীদের তালিকা করা হয়, যার ফলে সংরক্ষিত ও সাধারণ আসনের প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। প্রতিটি নির্বাচনী জেলায় একই সময়ে সাধারণ (প্রায় অধিকাংশই পুরুষ) প্রতিনিধি ও অতিরিক্ত (নারী) প্রতিনিধি দেখা যায়। সংরক্ষিত আসনের একজন সাংসদের তাঁর নির্বাচনী এলাকার একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগদানের খবরে তাঁকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সাংসদ বিদেশ থেকে হুমকি দিয়েছিলেন বলে একবার এক জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত বলে তিনি সরাসরি সাংসদ নন, বিধায় তাঁর নির্বাচনী এলাকায় প্রবেশের অধিকার নেই। এমনকি ওই সাংসদের সমর্থকেরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ওই নারী সাংসদের ওপর হামলাও করেন; ওই ঘটনায় অনেক শিশু আহত হয়। এরপর থেকে অনেক নারী সাংসদই নিজ নিজ এলাকার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সাংসদের অনুপস্থিতিতে গোপনে তাঁর নির্বাচনী এলাকা পরিদর্শন করেন।

সংরক্ষিত নারী সাংসদেরা মূলত দলীয় মনোনয়নের জন্য নিজেদের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় পরিদর্শনে যেতে চান। কিন্তু এতে তাঁদের সরাসরি নির্বাচিত সাংসদদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়।

বর্তমানে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনয়ন তালিকা মূলত দলীয় নেতারা তৈরি করে থাকেন। অন্যদিকে তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না, এ ক্ষেত্রে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির সঙ্গে দলের সখ্য, পরিচিতি ইত্যাদি বরং মেধার পরিবর্তে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এ সমস্যা সমাধানে প্রতিটি দলেরই মনোনয়নের ক্ষেত্রে এমন কিছু নিয়ম তৈরি করা উচিত। বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে সংরক্ষিত আসনে নারী সাংসদ নির্বাচনের জন্য পুরো দেশকে ৩০টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলে সরাসরি আসনে নির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে একটি করে ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ গঠন করা কিংবা নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে ৬৪টি করা এবং প্রতিটি জেলা থেকে একজন নারী সাংসদ নির্বাচিত করা যায় কি না। দলের নেতার তৈরি তালিকা নয়; বরং জাতীয় পর্যায়ে ‘বিশেষ নির্বাচনী এলাকা’ গঠনের মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনের জন্য শুধু যোগ্য নারীদের (ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট) মনোনয়নের ব্যবস্থা করা উচিত। ‘সুপার কনস্টিটিউয়েন্সি’ বা ‘সুপার ডিস্ট্রিক্ট’ মডেলও একটি বিকল্প প্রস্তাব; এতে আমরা সারা দেশের ৩০০টি আসনের পাশাপাশি মোট ৫০টি আসনকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি, যে আসনগুলো ‘বিশেষ সংসদীয় এলাকা’র মর্যাদা পাব। এই আসনগুলোর আলাদা ভোটার তালিকা থাকবে এবং সংসদ নির্বাচনের দিনেই একই সঙ্গে এসব আসনেও সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেবেন। যেহেতু এই আসনগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে, ফলে এখানে নারীদের বিপরীতে কেবল নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন; দেশের নারী অধিকার আন্দোলনের নেতারাও এমন ধারণার কথা বলে আসছেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। বিশেষ নির্বাচনী এলাকার সংখ্যা মোট সংরক্ষিত আসনের সমান (বর্তমানে ৫০) এবং প্রতিটি বিশেষ নির্বাচনী এলাকাকে ছয়টি সাধারণ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সংরক্ষিত আসনের মধ্য দিয়ে সমাজের কোন নারীরা সংসদে আসছেন? অভিজ্ঞতা বলে, সরাসরি নির্বাচনের আসনগুলোর মতোই সংরক্ষিত আসনগুলোও কেনাবেচা হয়, গ্ল্যামার জগতের নায়িকা-গায়িকা, রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়-স্বজন, মামা-চাচা, খালা-ফুফু, মা–বাবার বিবেচনা থেকে এই সংরক্ষিত আসনগুলো রেহাই পায় না। এসব কারণে এই আসনগুলো নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা হতে দেখা যায়। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের জন্য প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা অবশ্যই স্বচ্ছ এবং অনেক বেশি বিচার-বিবেচনা সাপেক্ষে হতে হবে। দলগুলো যদি ত্যাগী, তৃণমূলে, মাঠের রাজনীতিতে অভিজ্ঞ নেতাদের মনোনয়ন দিত, যাঁরা সত্যি সত্যি রাজনীতিটা করছেন, বুঝছেন, রাজনীতি নিয়ে বা আধুনিক দুনিয়া সম্পর্কে জানাশোনা আছে, যাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আছে, যাঁরা নিজেদের প্রস্তুত করছেন, তাহলে কিন্তু সংরক্ষিত নারী আসনের চিত্রটা পাল্টে যেত। এমনটি হলে রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমাজে নারীর রাজনীতির একটা গুণগত পরিবর্তনের সূচনা হতো।

যদিও কোটাব্যবস্থা নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশেই দ্বিমত আছে, এতত্সত্ত্বেও এটি একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক সমতা। আন্তর্জাতিকভাবে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় ধীরে হলেও নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক কোটার বিষয়টিকে একটি ইতিবাচক উপাদান, উদ্যোগ বা সমান সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দ্য ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ) তাদের ২০১২ সালের ‘প্ল্যান অব অ্যাকশন ফর জেন্ডার-সেনসিটিভ পার্লামেন্ট’ শীর্ষক সভায় সংসদে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং তাঁদের রাজনীতির মূলধারায় নিয়ে আসার বিষয়ে অঙ্গীকার করে। ওই সভায় বলা হয়, ‘একটি জেন্ডার সংবেদনশীল সংসদই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে একটি আধুনিক সংসদ।’ সে লক্ষ্যে, বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে।

রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক