হাঁকছে ডাকসু, বাড়ছে প্রশ্ন-স্বপ্ন

নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত না করে কেমন নির্বাচন আশা করা হচ্ছে?
নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত না করে কেমন নির্বাচন আশা করা হচ্ছে?

বাজনা বাজছে ডাকসু নির্বাচনের। ২৮ বছর পরে বেশ হাঁকডাক দিয়েই ডাকসু ফিরে এসেছে। অনেকটা ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা লেইস-ফিতাওয়ালার মতো। কেন এত আলোচনা এই নির্বাচন নিয়ে? কারণ, ডাকসু নির্বাচনসহ সব ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রোগাক্রান্ত গণতন্ত্রের জন্য খুবই জরুরি। তবে এমনি এমনি হেঁটে এত বছর পর ডাকসু আসেনি। তার জন্য ঘাম–শ্রম দিয়েও হয়নি; শেষ পর্যন্ত রিট করতে হয়েছে। তারপর আদালত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মার্চ অবধি সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু এর এক বছরের মাথায় মৃত্যু ঘটেছিল ডাকসুর। অথচ এর উল্টোটিই হওয়ার কথা ছিল। ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশে ডাকসুর অস্তিত্ব রয়েছে। রয়েছে ডাকসুর আলাদা গঠনতন্ত্র। সেই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিবছরই ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেখানে বাংলাদেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে মাত্র সাতবার সেই নির্বাচন হয়েছে।

নির্বাচন আয়োজনের জন্য বাহবা হাঁকানো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন ব্যস্ত অনেকটাই। শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা যে নেই, তাও নয়। মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ এবং প্রশাসন এক পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছে, আর অন্য সংগঠনগুলো ডাকসুকে হাতে রেখেই আন্দোলনমুখী। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ও তারিখ ঘোষণা এবং দফায় দফায় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্তি, ঐক্য, অনৈক্য নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো এগোলেও শেষমেশ আন্দোলন ভোটকেন্দ্রের স্থানে এসে ঝাঁজ পেয়েছে।

হল সংসদ গঠনতন্ত্রের ৮(ই) ধারা অনুযায়ী, প্রতিটি আবাসিক হলে একটি করে ভোটকেন্দ্র থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট হলের সদস্যরা কেবল সেই কেন্দ্রে ভোট দিতে পারবেন। তবে ছাত্রলীগ বাদে অধিকাংশ সংগঠন হলের ভোটকেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবে ও নিরাপদে ভোট দেওয়া সম্ভব নয় মনে করে। তাদের সুপারিশ, হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র করতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তা অনুমোদন দেয়নি। সব সংগঠনের সহাবস্থান, নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির দাবিও রয়েছে সব সংগঠনের। তবে ভোটকেন্দ্র আবাসিক হলগুলোয় রাখার বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদেরের সাম্প্রতিক নির্দেশমুখী বক্তব্য আবারও তলানিতে ঝুলের মতো টিকে থাকা স্বায়ত্তশাসনের গৌরবকে শুধু যে ম্লান করেছে তা নয়, বরং ডাকসু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তারকেই ইঙ্গিত করছে। অতীতে ডাকসু নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেই ছিল উল্লেখ করে এবারের নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রও হলেই হবে বলে একভাবে নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তবে মাননীয় মন্ত্রী, আপনার এটাও নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা যে ১৯৯৪ সালে তফসিল ঘোষণার পরও ডাকুস নির্বাচন করতে পারেনি তৎকালীন প্রশাসন। সে সময়ও ইস্যু ছিল এই ভোটকেন্দ্র। সে সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা ছাত্রলীগ ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে রাখার দাবি জানায়। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল হলেই ভোটকেন্দ্র রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়। সে সময় এই বিষয় নিয়ে সুরাহা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হয়নি ডাকসু নির্বাচন।

আসলে আমাদের কোনো নৈতিক অবস্থান নেই। ক্ষমতার স্বর আমাদের সুরের পরিবর্তন করে মাত্র। তাই তো সেই সময়কার ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সঙ্গে আজকের ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের পার্থক্য অনেক। এই পার্থক্য মূলতই ক্ষমতারই পার্থক্য। বর্তমানে এ দুটি সংগঠন আগের অবস্থানের বিপরীতে কথা বলছে, অর্থাৎ ছাত্রলীগ ভোটকেন্দ্র হলের ভেতরে রাখার পক্ষে আর ছাত্রদলসহ অন্যরা এর বিপক্ষে।

এ ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে রাখার দাবিতে ঘাড় কাত করে রেখেছে ক্রিয়াশীল বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য। তারা জারি রেখেছে তাদের প্রতিবাদ।

কেন ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে করা দাবি এতটা যৌক্তিক হয়ে উঠেছে? এর প্রধান কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো সবই সরকারদলীয় সংগঠন ছাত্রলীগের দখলে এবং নিয়ন্ত্রণে। সেখান থেকেই অনেক আগেই বিতাড়িত হয়েছেন ছাত্রদলের নেতারা। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এর বিপরীত চিত্র ছিল। অর্থাৎ ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণে ছিল হলগুলো। কোনো কোনো হলে হল প্রশাসন অনেকটাই ছেড়ে দেয় ক্ষমতাসীন সংগঠনের হাতে। সিট বণ্টন থেকে শুরু করে বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণই তাদের হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে এই চিত্রই চলছে, তাও কয়েক যুগ হলো। বাম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অবস্থাও যে সম–অবস্থানের, তা নয়। বরং কমনরুম, টিভিরুমে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অজুহাতে ক্ষমতাসীন সংগঠনের হাতে হেনস্তা হওয়ার ঘটনাই বছরজুড়ে চলমান থাকে। আর যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম সংগঠনের নেতৃত্বে কোনো ধরনের আন্দোলন হয়, তাহলে এই হেনস্তা শারীরিক নিপীড়নে ঠেকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে হলে থাকা শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি চাপে থাকেন। সরকারি ছাত্রসংগঠনের মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়ার চাপ অনেকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আনন্দকে চুপসে দেয় অনেকখানিই। হলগুলোয় প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয় আসার আগে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকার কারণে হলগুলোয় তাঁরা চাপের মুখে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন সংগঠনের দাপট এতটাই যে বছর দুয়েক আগে সামান্য একটি ক্যালকুলেটরের জন্য চোখ হারিয়েছিলেন একজন ছাত্র।

এই পরিস্থিতির কোনোটাই আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের দাবিই বরং অচেনা। যেখানে বারবার বলা হচ্ছে সব সংগঠনের সহাবস্থান রয়েছে, যা ডাকসু নির্বাচনের অন্যতম রাজনৈতিক শর্ত। হলে ভোটকেন্দ্র হলে কী কী সমস্যা হতে পারে? প্রথম প্রশ্নটিই হলো ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন নিয়ন্ত্রণাধীন হলের কেন্দ্রে সব শিক্ষার্থী কি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন? হলে ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতারা ‘চিনে রাখছি’ কিংবা ‘খবর আছে’ ধরনের ভয়/হুমকির মধ্যে রাখবেন না তো হলে থাকা শিক্ষার্থীদের? ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ভয়, মানসিক চাপের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিবেচনায় রাখছে তো?

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হলের বাইরে থাকা কিন্তু হলের সঙ্গে সংযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৬৫ ভাগ ছাত্র হলের বাইরে থাকেন। তাঁরা হলের এই ধরনের সরকারি সংগঠনের নিয়ন্ত্রণাধীন নন এবং হলের এই পরিবেশের সঙ্গে পরিচিতও নন। সে ক্ষেত্রে ভয়ভীতি কিংবা চাপের কারণে তাঁরা হলের কেন্দ্রে ভোট দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ নাও করতে পারেন।

বাম সংগঠনগুলোর দাবি, ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে নেওয়া ও সহাবস্থানের দাবি পূরণ না করেই তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা রয়েছে এবং প্রয়োজনে আরও লাগানো হবে। এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, হাতে প্রমাণ থাকার পরও কয়টা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পেরেছে? এমনকি আট বছর আগে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হওয়া ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের খুনিদেরও এখনো বিচার হয়নি।

ডাকসু নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব সংগঠনের মধ্যে ভয়হীন সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারবে কি না, সেটি বলা কঠিন। তবে দীর্ঘ ১০ বছর পর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে মিছিল করে তাদের ‘নিভু নিভু’ অস্তিত্বের জানান দিয়েছে। হালের খবর মধুর ক্যানটিনেও তাদের শুধু উঁকিঝুঁকি নয়, টেবিলে বসা শুরু হয়েছে। এটুকু অগ্রগতি তবু স্বস্তির। এই স্বস্তি ভিত্তি দেয় স্বপ্নের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে আইনের মধ্যে থেকেই তারা নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে প্রশাসনিক বা একাডেমিক ভবনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, হয়তো পারবেই...স্বস্তি আর স্বপ্নরা একই সঙ্গে মিলমিশে থাকে যে!

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]