মফস্বলের 'আহা, ইশ্' আহাজারি

অনেকেই দল বেঁধে বইমেলায় যান। ছবি: আবদুস সালাম
অনেকেই দল বেঁধে বইমেলায় যান। ছবি: আবদুস সালাম

ঢাকায় চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বছরের বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে ঢাকায়, স্বল্প পরিসরে বইমেলা হয়। কিন্তু মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার আবেদন, মেজাজ, শক্তি ও চেতনা অন্য মেলার চেয়ে ভিন্ন। এখানে লেখক-সাহিত্যিকেরা আসেন নতুন বই নিয়ে, প্রকাশকেরা আসেন অন্য সময়ের চেয়ে বেশ কিছুটা বাড়তি মূল্যছাড় নিয়ে। সেই সঙ্গে বেশ আগ্রহ নিয়েই আসেন বইয়ের পাঠকেরা। এ যেন ত্রিভুজের কানাকানি। বইমেলা অনেকটা মিলনমেলার মতো। বইমেলার অভ্যন্তরীণ অনেক কিছু আছে, যা মেলার ক্রেতা-বিক্রেতা সম্পর্কের বাইরে। এ জন্য অনেকে এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিদেশ থেকে ছুটে আসেন দেশে, পুরা বইমেলায় দেশে থাকেন। পাঠকের সঙ্গে লেখক-প্রকাশকের দেখা হওয়ার, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ যেন বইমেলাই দেয়।

নতুন বইয়ের ঘ্রাণে ভরে যায় পত্রিকার পাতা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও করে বাড়তি আয়োজন। পাঠকেরা পছন্দের বই কিনে সেটিতে লেখকের অটোগ্রাফ নেন, এটা পাঠকের জন্য অনেক আনন্দের। যদিও এখন অটোগ্রাফের জায়গা অনেকখানি দখল করেছে হালের ‘সেলফি’। বাংলাদেশের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মেলার পরিধি। ১৯৭২ সালে ৩২টি বই চটের ওপর বিছিয়ে যে বইমেলার অনানুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে, সেই মেলা বাংলা একাডেমির জমিনের পরিসর মাড়িয়ে, পিচঢালা চলাচলের রাস্তা পেরিয়ে এক মাসের আস্তানা গাড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠে।

বইমেলায় একুশে ফেব্রুয়ারির পরই বাড়ে মূলত ক্রেতার সংখ্যা। কারণ, তখন প্রকাশকেরা বেশির ভাগ বই বাজারে আনেন। প্রথম তিন সপ্তাহে সব বই বাজারে আনতে পারেন না। প্রতিদিনই নতুন নতুন বই আসছে বইমেলায়। ফেসবুকজুড়েই বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আগত বিভিন্ন বয়সী মানুষের ছবি দেখি। এর সঙ্গে সঙ্গে পড়ি প্রকাশক বন্ধুদের আহাজারি। বই বিক্রি হচ্ছে না। অন্তত মেলার প্রথম ১৫ দিন তেমন বিক্রি হয়তো হয়নি। বেশির ভাগ দর্শকই মেলায় আসেন, ঘোরাঘুরি করেন, আড্ডা দেন, ছবি তোলেন।

অনেক প্রকাশক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘মধ্যবিত্তের এখন বইমেলায় আসা অনেকটা স্ট্যাটাসের মতো।’ দু-একজন প্রকাশক অবশ্য বলছেন, মেলায় আসা ক্রেতাদের এক হাজারে একজন বই কেনেন। এই মন্তব্য খুব বেশি বাড়াবাড়ি হবে কি না জানি না। এখনকার ঢাকা শহরের উচ্চবিত্ত অনেকের বাড়িতেই যত দামি দামি শোপিস দেখি, ঘরে কোনো বইয়ের আলমারি দেখি না। কিন্তু মফস্বলে কেন জানি এখনো অনেক বাড়িতেই বইয়ের আলমারি কিংবা ভাঙাচোরা, ক্ষয়ে যাওয়া কাঠের বইয়ের তাক দেখি। এই বইমেলাকে কেন্দ্র করেই ঢাকার বাইরে থেকে আসেন তাঁরা, বই কেনেন। কারণ, তাঁরা বই কেনার জন্যই ছুটি নিয়ে কিংবা ছুটি দেখে চলে আসেন ঢাকায়। এর আগেই পত্রিকায় পড়ে কিংবা নিজের আগ্রহ এবং প্রয়োজনের সঙ্গে মিল রেখে কিংবা ফেসবুক দেখে বইয়ের তালিকা করে তারপর বইমেলায় আসেন। অনেকের পক্ষেই মন চাইলেও মেনে নিতে হয় বাস্তবতাকে। বই কেনার টাকাসহ, ঢাকায় আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার খরচ বিবেচনায় মনকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। এর পাশাপাশি বাচ্চাদের স্কুল-কলেজের ছুটিও হয়তো মেলে না, পরিবারসহ হাজির হওয়া যায় না।

তাহলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা কি ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া যায় না? বাংলাদেশে এখনো বড় শহরগুলো ছাড়া মফস্বল শহরগুলোয় খুব বেশি বইয়ের দোকান নেই। দু-চারটি বইয়ের দোকান বইয়ের চাহিদা খুব বেশি পূরণ করতে পারবে—সেটি আশা করাও কঠিন। অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, সেসব বইয়ের দোকানে গাইড বই ছাড়া দু-চারজন নামী লেখকের বই পাওয়া যায়। ঢাকাতেও যে খুব বেশি বইয়ের দোকান আছে, তা–ও বলা যাবে না। আগে বইয়ের মার্কেট বলতে সবাই শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটকেই বুঝত। আমাদের কৈশোরে, তারুণ্যের একটা বড় জায়গা ছিল আজিজ সুপার মার্কেটের আড্ডা, যার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল বইয়ের দোকান এবং লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে। মনে হতো, বইপাড়ার যে লড়াকু মেজাজ এবং বনিয়াদ থাকা দরকার, সেটি এই মার্কেটেরই আছে। এখন আজিজ সুপার মার্কেটে গেলে মনে হয়, কে যেন সব খামচে নিয়ে গেছে, থামিয়ে দিয়েছে সেই কোলাহল। বইয়ের দোকান উঠে গিয়ে এখন সব কাপড়চোপড়ের পসরা। বইয়ের ব্যবসা ভালো চলে না।

আমরা কীভাবে যেন জেনে গেছি, এখন মানুষ কাপড়চোপড়ই বেশি কেনে, বই কেনে না। তবু এই ‘বই না কেনার’ দিনে অল্প কয়েকটি বইয়ের দোকান আজিজ সুপার মার্কেটে নস্টালজিয়ার মতো টিকে আছে। বই নিয়ে এত হতাশার মধ্যেও বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র, বাতিঘর, দীপনপুর, বেঙ্গল বই, নিউমার্কেট এবং কনকর্ড টাওয়ারের কয়েকটি বইয়ের দোকান ঢাকার বুক চিরে বুক টান টান করে এখনো বইয়ের নিবুনিবু করা আলোটি জ্বালিয়ে রেখেছে।

তাই বইকে পাঠকের কাছে সহজলভ্য করা এবং বইপ্রেমী পাঠক তৈরি করার জন্য যদি একুশে গ্রন্থমেলা ঢাকার পাশাপাশি অন্য সব মফস্বল শহরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একই সঙ্গে চালু করা যায়, তাহলে বইমেলার চেতনা, গুরুত্ব এবং বইয়ের কদর অনেকাংশে বাড়বে। প্রকাশকেরা মফস্বলেও তাঁদের বই নিয়ে যাবেন। পরিচিত হবেন মফস্বলের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। তাঁদের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক-সাহিত্যিক, যাঁরা এখনো মফস্বলের অলিগলিতে সাহিত্যসাধনা করছেন, তাঁরা প্রকাশিত হবেন, গ্রন্থিত হবেন। লেখকেরাও মফস্বলের পাঠকদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পাবেন, তাঁদের লেখা নিয়ে শুধু ঢাকাতেই নয়, মফস্বলেও আলাপ-আলোচনার সুযোগ হবে। সেখানেও লেখক, প্রকাশক, পাঠক যোগাযোগ হবেন।

মফস্বলের মধ্যবিত্তের বইয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয়ের ঝুলিতে অযথাই যোগ দিতে হবে না বাড়তি যাতায়াতের টাকা, অফিস থেকে নিতে হবে না বাড়তি ছুটি। মফস্বলের শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ শেষে নিশ্চিন্তে যোগ দিতে পারবে এই বইমেলায়। বইকেন্দ্রিক মফস্বলের শিশু-কিশোর-তারুণ্যের ঢাকায় হওয়া একুশে গ্রন্থমেলায় না যেতে পারার ‘আহা, ইশ্‌’ আহাজারির প্রতি আমাদের মনোযোগী হতে হবে। আর এই মনোযোগ কমাবে প্রকাশকের বই বিক্রি না হওয়ার আক্ষেপ, বাড়াবে বইয়ের প্রতি আগ্রহ। আর আমরাই হয়তো পাব বইপ্রেমী প্রজন্ম। ঢাকার পাশাপাশি মফস্বলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব?

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]