রক্তের বাঁধন ছাড়িয়ে

বর্তমানে সেলফির যুগ। ফেসবুকে, সংবাদপত্রের পাতায়, টিভিতে, সর্বত্র আত্মপ্রচারণার জয়জয়কার। নিজেকে, পরিবারের সদস্যদের ও নিকটাত্মীয়দের ঘিরেই আমাদের বেশির ভাগ মানুষের জীবন। কিন্তু এমনও মানুষ আছেন, যাঁরা কোনো বিনিময়ের প্রত্যাশা ছাড়াই অপরিচিতজনকে সাহায্য, অর্থসহায়তা ও সময় দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি এ ধরনের মানুষদের আয়োজিত একটি সভায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমার যোগদানের সুযোগ হয়েছিল। অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর আয়োজন। অনুষ্ঠানস্থল হচ্ছে বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তন। উদ্যোক্তারা আমাকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে নিয়ে 

যান। অপরিসর গলি, সামনে রাস্তা মেরামত হচ্ছে, তাই পেছন দিকে ঘুরে যেতে হয়। মিলনায়তন কক্ষটিও জৌলুশহীন। প্রজেক্টর স্ক্রিনের অভাবে, সাদা কাপড়ের ওপর প্রজেক্টর থেকে ছবি প্রক্ষেপণ করতে হয়েছে। বসার আসনগুলোও ভাড়া করা এবং খুবই সাদামাটা।

বাংলাদেশ ব্লাড ডোনারস ফোরাম তাদের সংগঠনের পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, দেশব্যাপী তাদের নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ জনের বেশি। দেশের ৬৪টি জেলায় তাদের কার্যক্রম রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জনের বেশি রক্তদাতা রক্ত দান করেন। এ ছাড়া সংগঠনটি একটি অ্যানড্রয়েড অ্যাপ ‘ব্লাড ম্যানেজার’ তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে রক্তদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সহজতর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন রক্তদাতার সন্ধান মিলছে। তারা বিনা মূল্যে ব্লাড গ্রুপিং করে থাকে এবং রক্তদানে উদ্বুদ্ধসহ এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারণা চালিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিবছর রক্তের সরবরাহ ১ লাখ ইউনিট কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে দেশে জনসংখ্যার ২-৩ শতাংশের নিয়মিত রক্ত প্রদান করা প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল নির্বাচিত রক্তদাতা, স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনকে সম্মাননা প্রদান। অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো রক্তদান করা ছাড়াও মাদক, মানব পাচার প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও নিরোধ কার্যক্রমে সহায়তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে থাকে। সংবর্ধিত স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোর পক্ষে কয়েকজন অনুষ্ঠানে তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। এঁদের অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। লালমনিরহাট থেকে আগত একজন স্বেচ্ছাসেবক তাঁদের কাজ কতটা কঠিন, তার বর্ণনা দিলেন। কিন্তু শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এসব স্বেচ্ছাসেবক তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বক্তারা সবাই ছিলেন বয়সে তরুণ এবং অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসা।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত আমার মতো আরেকজন অতিথি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সিনিয়র কনসালট্যান্ট লিয়াকত জাহান তাঁর বক্তৃতায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা টেনে শ্রোতাদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনাদের বয়সে আমরা যখন অর্থ উপার্জন, নিজের পেশাগত উন্নতির পেছনে ছুটছি, আপনারা তখন আপনাদের রক্ত দিয়ে মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাচ্ছেন। আপনাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করেই, বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধান ও আর্তমানবতার সেবায় ব্যয় করছেন। আপনাদের কাছে আজ নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।’ লিয়াকত জাহান অনুষ্ঠানে উপস্থিত সব অতিথির মনের কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। এঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আমারও নিজেকে খুব খাটো মনে হলো।

দেশ-বিদেশে অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে থাকেন, তোমাদের দেশে খাদ্যে এত ভেজাল, এত পরিবেশদূষণ, দুর্ঘটনা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এত ভঙ্গুর, এরপরও বাংলাদেশের মানুষের গড়পড়তা আয়ু ৭২ বছরে উন্নীত হয় কী করে? তোমাদের দেশে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে মাত্র ৩২ দশমিক ৪ জন হয় কীভাবে? যেখানে অপেক্ষাকৃত ধনী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই হার ৩৯ জন? এ কৃতিত্বের দাবি নিশ্চয়ই অনেকেই করবেন। সরকার বলবে, এটা তাদের কৃতিত্ব। সব প্রচার ও সম্প্রচারমাধ্যমও তা ফলাও করে বলবে। এনজিওগুলো বলবে, এটা তাদের কৃতিত্ব। এনজিওগুলোর পরিচিতি ও সুপরিচিত মুখ আছে। তাদের দাবিও উপেক্ষা করা যাবে না।

আজ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর এই অনুষ্ঠানে এসে এবং স্বেচ্ছাসেবকদের বক্তব্য শুনে মনে হলো, বাংলাদেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের ভেতরের রহস্য সম্পর্কে আমি ধারণা পেয়ে গেছি। আমার সামনে উপবিষ্ট তরুণ স্বেচ্ছাসেবকেরা ও দেশজুড়ে তাঁদের মতো অসংখ্য কর্মী বাহিনী দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের কৃতিত্বের সিংহভাগের দাবিদার। কিন্তু দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব সংগঠনের কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। নেই তাঁদের সহায়তা করার জন্য ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। তাই আজ বাংলাদেশ ব্লাড ডোনারস ফোরাম নিজে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হয়েও অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবকদের সংবর্ধনার আয়োজন করেছে।

চ্যারিটিস এইড ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড গিভিং ইনডেক্স-২০১৭ অনুযায়ী বাংলাদেশের মাত্র ১৮ শতাংশ মানুষ অপরিচিত মানুষকে সাহায্য, আর্থিক অনুদান প্রদান এবং স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম—এই তিনটির এক বা একাধিক কাজ করে থাকে। নেপাল ও ভারতের ক্ষেত্রে এ হার যথাক্রমে ৩৬ শতাংশ ও ৩১ শতাংশ। সমীক্ষাধীন ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯। অন্যদিকে, নেপাল ও ভারতের অবস্থান যথাক্রমে ৫১ ও ৮১। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ পাঠক্রমেরই অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশে অনেক ছাত্র-ছাত্রীই কোনো স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করেই শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি, কয়েক বিলিয়ন ডলার টার্নওভারের প্রতিষ্ঠানের অতি ব্যস্ত সিইওকেও প্রতি মাসে ৬ ঘণ্টা ওল্ড এজ হোমের বুড়োদের পার্কে, ডাক্তারের কাছে, রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া এমন সব কাজে সময় দিতে।

 তাই, স্কুল থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। সমাজের যাঁরা রক্তদান করতে বা সময় দিতে পারবেন না, তাঁরা আর্থিকভাবে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহকে সাহায্য করবেন। সরকারকেও এসব প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে হবে। এ দুর্দিনে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের জন্য অর্থ সংগ্রহ একটি কঠিন কাজ। সরকার ও দাতাদের সাহায্য পেলে এরা দুস্থদের সহায়তায় আরও মনোযোগ দিতে এবং তাদের কাজের পরিধি বাড়াতে সক্ষম হবে। সর্বোপরি, স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাক, আর্তমানবতার দুঃখভার লাঘব হোক!

 মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অধ্যাপক