পরিকল্পিত ও 'পুনর্জাগরিত' নিরাপদ নগর চাই

গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফাইল ছবি
গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফাইল ছবি

গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় সংঘটিত অগ্নিবিস্ফোরণজনিত হতাহতের কারণে গোটা নগর ও দেশবাসী যখন দুঃখ ভারাক্রান্ত, আমরা পরিবেশবাদীরাও তখন বিক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। প্রায় নয় বছর আগে ৩ জুন ২০১০-এ সংঘটিত নিমতলী দুর্ঘটনার পর থেকে যে গণ-আন্দোলন তৈরি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইকবাল খান চৌধুরীর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত ও পরবর্তী সময়ে সরকার কর্তৃক ১৭ দফা সুপারিশ গৃহীত হয়। ওই সুপারিশের মধ্যে ৬টিই মূলত আবাসিক এলাকা থেকে দাহ্য বা তেজস্ক্রিয় হিসেবে চিহ্নিত প্রায় ২৯টি দ্রব্যের আমদানি, মজুত ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা; তার সুষ্ঠু পরিবহন, মজুত ও ব্যবহার নিশ্চিতের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা–সংক্রান্ত। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক জঞ্জালকেন্দ্রিক সম্ভাব্য দুর্যোগমুক্ত করা, ফায়ার হাইড্রোজ স্থাপনের মাধ্যমে সম্ভাব্য দুর্যোগমুক্ত করা ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। এসবের সঙ্গে জনসচেতনতা কার্যক্রম ও জননিরাপত্তায় লোকবল প্রস্তুতকরণবিষয়ক উদ্যোগ নিশ্চিতও অন্যতম করণীয় ছিল। কিন্তু নয় বছর ধরে এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে চরম অবজ্ঞা, অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তায় পুরো জনপদকে ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবছর নিমতলী দিবসে এ-সংক্রান্ত আলোচনা, ধরনা, মানববন্ধনসহ অন্যান্য কর্মসূচির চাপ থাকা সত্ত্বেও বিষয়সংশ্লিষ্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনসহ সবাই নির্বিকার ও অনিশ্চিত ভূমিকা পালন করে। এই অবহেলা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বন্যায় প্রতিবছর সংঘটিত অজস্র অগ্নিদুর্ঘটনা ‘মামুলি’ হিসেবে ভেসে যায়। ফলে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রতিশ্রুতি বিসিকের অধীনে বিশেষ শিল্পাঞ্চল তৈরির মাধ্যমে দাহ্য বা রাসায়নিক বস্তুর মজুত, ব্যবহার ও বসত অঞ্চল থেকে শিল্পের অপসারণ কার্যক্রমও ভেস্তে যায়। এই সুযোগে নিমতলীর ঘটনার সময় গণ-আন্দোলনের চাপে সরে যাওয়া অবৈধ মজুতদার ও অসৎ ব্যবসায়ীরা ফিরে এসে এই জনপদকে আরও ব্যাপক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেন। কিছু লোভী বাড়িওয়ালার কারণে ও কিছু অসাধু অতিলোভী গোষ্ঠীর কাছে পদানত হয়ে এই জনপদের মানুষের মৃত্যুও যেন অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়।

একই সঙ্গে রাজউকের ২০১০ সালে প্রণীত ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের বিশদ নগরাঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপে সব অপরিকল্পিত সম্ভাব্য দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলগুলোর জন্য পরিকল্পিত উন্নয়ন রূপরেখা ও পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের অঞ্চলকে তার ঐতিহ্য, সামাজিক বনিয়াদ আর ব্যবসায়িক সম্ভাবনার আলোকে ‘পুনর্গঠন’-এর কোনো প্রয়াস বা উদ্যোগ অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। উপরন্তু ‘রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের’ অভাবে সেই ‘ড্যাপ’ও আজ অপাঙ্‌ক্তেয় প্রায়। সেই সঙ্গে পূর্বোল্লিখিত সংস্থাসহ সিটি করপোরেশন শুধু লাইসেন্স প্রদানের মধ্যে কার্যত তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রেখেছে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ বা পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের অভাবেই অঞ্চলজুড়ে বিনা প্রতিরোধে ভয়ানক কিন্তু অবারিত ব্যবসায়িক দুর্বৃত্তায়ন সৃষ্টি হয়। আর এ কারণেই চুড়িহাট্টায় ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ও তার পরদিন এতগুলো প্রাণের ‘অবহেলা আর নিষ্ক্রিয়তাজনিত হত্যাকাণ্ড’ প্রত্যক্ষ করতে হয়।

পরস্পরের দোষারোপের নাটক থেকে বের হয়ে এসে তাই আজ জরুরি করণীয় হচ্ছে:

১. নিমতলী-পরবর্তী ১৭টি সিদ্ধান্তের প্রতিটির আশু বাস্তবায়নও অন্য সব সম্ভাব্য বিপদ চিহ্নিত করে নগরীর আবাসন দুর্যোগ মোকাবিলায় জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

২. মানবিক ও বসবাসযোগ্য উন্নয়নে যথাযথ ব্যক্তির দ্বারা গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ নিশ্চিত এবং তদনুযায়ী উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

৩. দুর্যোগমুক্ত নগরায়ণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনসম্পৃক্ততায় সিক্ত ও রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের শক্তিতে শক্তিমান গণ-আন্দোলনে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে যুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

৪. একটি ‘কমপ্লায়েন্স কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিটি আবাসন ও বসতিকে দুর্যোগমুক্ত এবং বসবাসযোগ্য করার উদ্যোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এই প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর নবায়ন বাধ্যতামূলক করে জনবান্ধব ও পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হবে।

৫. অতি দ্রুত ‘বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড’ (বিএনবিসি)-এর সংশোধিত সংস্করণের সম্পাদন আশু ও জরুরি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

(চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) ২০টি সামাজিক সংগঠন আয়োজিত ১ মার্চ নাগরিক সমাবেশে দেওয়া মূল বক্তব্য।)

ইকবাল হাবিব: স্থপতি ও বাপা নগরায়ণ উপকমিটির সদস্যসচিব