নতুন আদলে বইমেলার যাত্রা শুরু

চট্টগ্রামে অমর একুশে গ্রন্থমেলা
চট্টগ্রামে অমর একুশে গ্রন্থমেলা

বইমেলার আয়োজন করা সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। কিন্তু কর্মসীমার পরিধি বিস্তৃত করে জনহিতকর কাজে হাত দেওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঐতিহ্য। এই প্রতিষ্ঠান যখন পৌরসভা হিসেবে পরিচিত ছিল, তখন থেকেই এর চেয়ারম্যান নূর আহমদ শিক্ষার প্রসারের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আজ সিটি করপোরেশনের পরিচালনাধীন ৮০টি স্কুল ও কলেজ নূর আহমদ চেয়ারম্যান অগ্রসর ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাশক্তির কথাই মনে করিয়ে দেয়। এরপর প্রয়াত রাজনীতিক ও সিটি করপোরেশনের তিনবার নির্বাচিত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে এই শিক্ষা কার্যক্রম আরও প্রসারিত হয়েছে। নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বেশ কটি কলেজ ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় (প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি) প্রতিষ্ঠা এবং এগুলোর শিক্ষার মান অক্ষুণ্ন রাখার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ও নজরদারি সর্বজনবিদিত। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) নামের একটি দৃষ্টিনন্দন মিলনায়তন প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃতিকর্মীদের কাছেও কৃতজ্ঞভাজন হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

অতঃপর সিটি করপোরেশন এই অঞ্চলের মানুষের জ্ঞান ও সৃজনশীলতার চর্চাকে উৎসাহিত করতে, নবীন-প্রবীণ নাগরিকের বই পাঠের আগ্রহকে মূল্য দিতে এগিয়ে আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা হয়ে আসছে দীর্ঘদিন। কিন্তু এই মেলা কখনোই দেশের দ্বিতীয় প্রধান শহরটির পাঠক চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। পারেনি, কারণ এই আয়োজনে না ছিল সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছাপ, না দেশের নামী প্রকাশনা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ।

যত দূর মনে পড়ে, আশির দশকে একবার চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের মাঠে জমজমাট একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর নব্বইয়ের শুরুতে পাবলিক লাইব্রেরিতে আয়োজিত বইমেলায়ও পাঠক-দর্শক সমাগম হয়েছিল যথেষ্ট। এ দুটি বইমেলারই উদ্যোক্তা ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। কিন্তু এরপর আর কখনোই চট্টগ্রামে বইমেলার আয়োজন সত্যিকার অর্থে সফল হয়নি।

গত বছর (২০১৭) মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তন প্রাঙ্গণে সিটি করপোরেশন আয়োজিত বইমেলায় এর পরিকল্পনাহীনতা ও দৈন্য নিয়ে চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। বইমেলার উদ্বোধন করতে এসে খোদ এর উদ্বোধক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন তাঁর অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার বাংলা একাডেমির বইমেলার সঙ্গে এর তুলনা টেনে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন এ অঞ্চলের লেখক-পাঠক ও সুধীজনেরা। মেয়র তখন কথা দিয়েছিলেন পরবর্তী বছর আগেভাগেই সংশ্লিষ্ট সব মহলের পরামর্শ অনুযায়ী সুন্দর গোছালো একটি বইমেলা আয়োজনের পরিকল্পনা করবেন তিনি।

মেয়র তাঁর কথা রেখেছেন। এ বছর ফেব্রুয়ারির বইমেলা সামনে রেখে দুই মাস আগেই লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সবার পরামর্শ অনুযায়ী চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়াম জিমনেসিয়ামের সামনের মাঠটিতে ১০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আগের বছরগুলোতে মুসলিম ইনস্টিটিউট চত্বর, ডিসি হিল, কখনো–বা লালদীঘির মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে অমর একুশের বইমেলার নামে অগোছালো আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে। পাঠক-দর্শকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়েছেন। গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারেননি তাঁরা। লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীদের দাবি ছিল প্রতিবছর অভিন্ন স্থানে, অভিন্ন সময়সূচি মেনে একটি বইমেলা হোক। মেয়র এই দাবির প্রতিও সম্মান দেখিয়েছেন এবং প্রতিবছর অভিন্ন স্থান ও সময়ে বইমেলা করার ঘোষণা দিয়েছেন। এবারও বিভিন্ন স্থানে পৃথক বইমেলা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কেউ কেউ, কিন্তু মেয়রের সরাসরি হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়।

মেয়রের এই উদ্যোগের সাফল্য পাওয়া গেছে প্রথম বছরেই। লেখক-পাঠকেরা তাঁদের গন্তব্য খুঁজে পেয়েছেন। পরিকল্পিত এই উদ্যোগের ফলে চট্টগ্রাম ও ঢাকার ১১০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও গ্রন্থবিপণি মেলায় অংশ নিয়েছে। পাঠকদের মধ্যে যে বিপুল উৎসাহের সঞ্চার হয়েছে, তার প্রমাণ ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়া দুটি দিনের সাময়িক অসুবিধার মধ্যেও ১৯ দিনে ১৩ কোটি টাকার বই বিক্রি। মেলামঞ্চে প্রতিদিনই ছিল নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন।

সব মিলিয়ে এতকাল ধরে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন মেলা আয়োজনের পর এবারই আমরা বলতে পারছি, চট্টগ্রামে অমর একুশে বইমেলার যাত্রা হলো শুরু।

অসংগতি কিছু ছিল না এ কথা বলা যায় না। যেমন সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, চট্টগ্রামে থেকেও যাঁরা দেশব্যাপী পরিচিত তাঁদের কর্ম ও কৃতির জন্য, তাঁদের কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ডাকা হয়নি চট্টগ্রামের বহুল পরিচিত সাংস্কৃতিক ও আবৃত্তি সংগঠনগুলোকে। অথচ এই ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে মেলামঞ্চের সভা-সেমিনার ও অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধি পেত। সর্বোপরি মেলা কমিটিতে তরুণদের সমাবেশ ঘটানো গেলে তাঁদের নতুনতর চিন্তা ও পরিকল্পনার সুফলও পাওয়া যেত বলে আমাদের বিশ্বাস।

মেলার বেশ কিছু স্টলের সজ্জা মনোরম ও নান্দনিক হলেও অনেক প্রকাশনা সংস্থা কোনো সজ্জা ছাড়াই করপোরেশনের বরাদ্দ দেওয়া পর্দাঘেরা কক্ষে টেবিলের ওপর বইয়ের পসরা নিয়ে বসে পড়েছে। এতে মেলার সৌন্দর্যহানি ঘটেছে। আগামী বছর থেকে স্টলের সজ্জা বাধ্যতামূলক করা দরকার। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সিটি করপোরেশন নিজেরাই একই নকশায় সব কটি স্টল সজ্জিত করতে পারে, এর ব্যয় বাবদ স্টল বরাদ্দের সময় প্রকাশনা সংস্থা ও গ্রন্থবিপণির কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে অর্থ আদায় করতে পারে করপোরেশন।

দু-একটা ত্রুটিবিচ্যুতির কথা বাদ দিলে এবারের বইমেলাটিকে সফলই বলতে হবে। এখন এর পরিসর বৃদ্ধির কথাটিও উঠছে। মেয়র এ ব্যাপারেও ভবিষ্যতে উদ্যোগ নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা তাঁর কথায় আস্থা রাখতে চাই।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]