দুর্নীতি ও রাজনৈতিক নারীর শিরদাঁড়া

আইনমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত জোডি উইলসন। রয়টার্স ফাইল ছবি।
আইনমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত জোডি উইলসন। রয়টার্স ফাইল ছবি।

সম্প্রতি কানাডার রাজনীতিতে ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে সে দেশের বড় নির্মাণ কোম্পানি এসএনসি লাভালিন। মন্ট্রিয়লভিত্তিক কানাডার এই কনস্ট্রাকশন জায়ান্ট কানাডার রাজনীতিকে এক গভীর আবর্তে ঠেলে দিয়েছে। কোম্পানিটি সারা বিশ্বে বিলিয়ন ডলারের নির্মাণকাজ করে। লক্ষ্য তৃতীয় বিশ্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষী উন্নয়ন-ক্ষুধার্ত দেশগুলো। নাইজেরিয়া, পাকিস্তানসহ আরও অনেক দেশ এদের লক্ষ্য। এই সব দেশকে কোম্পানির পছন্দের কারণ ‘দুর্নীতি’ দেশগুলোর উন্নয়ন-অনুষঙ্গ। রাজনীতিবিদদের পকেটে নগদ নারায়ণ চালান দেওয়ার সহজ সুযোগ নিয়ে বড় বড় নির্মাণকাজ বাগিয়ে নেওয়ার একটি অনৈতিক ব্যবসারীতি তৈরি করে বসেছিল কোম্পানিটি।

‘নৈতিকতা’ বিষয়টি কানাডার সংবিধানে আছে কি নেই, জনগণ জানতে চায় না—শুধু দেখতে চায়, দেশটির রাজনৈতিক অর্থনীতি তো বটেই রাজনীতিকেরাও কখনোই নৈতিকতাবিবর্জিত পথে হাঁটবেন না। কিন্তু দিন শেষে কানাডাও একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ। এসএনসি লাভালিনও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে, ক্ষমতাধরদের ব্যবহার করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গিয়েছিল। অনেক দেশে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার কারণে কানাডার আইনেই মামলা-মোকদ্দমায় পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানির শেয়ারের দরপতন ঠেকানো যাচ্ছিল না। শেয়ারহোল্ডাররা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রচুর ছাঁটাই করেও কোম্পানি খাবি খাচ্ছিল।

কোম্পানিটির কার্যালয় কুইবেক প্রদেশের রাজধানী মন্ট্রিয়েলে। গত নির্বাচনে ট্রুডোর দল লিবারেল পার্টি এখানে ভূমিধস বিজয় পেয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। আগামী নির্বাচনেও এই ধারা অব্যাহত রাখতেই হবে—এ ধরনের মাথাব্যথা থেকেই লিবারেল দল সম্ভবত এসএনসিকে নিজেদের পক্ষে রাখতে চেয়েছিল। এসএনসিও এই সুযোগ নিয়ে কিছু আইনি ঝুটঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রে এই সব অপচেষ্টা যে কী রকম হিতে-বিপরীত হতে পারে তার উদাহরণ সরকারের দুজন প্রভাবশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নারীর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ।

দুজন নারীই নৈতিক কারণে পদত্যাগ করলেন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী আকারে–ইঙ্গিতে অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত জোডি উইলসনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আইনকানুন চেখে দেখতে কোনোভাবে এসএনসির মামলা-ঝামেলার চাপ কমিয়ে আনা যায় কি না! প্রধানমন্ত্রী বললেন, তিনি এসএনসির জন্য পক্ষপাতমূলক কিছু বলেননি; সুবিধা চাননি। পদত্যাগী জোডি উইলসন র‍্যেবুল্ড এথিক্স কমিশনে তথ্যপ্রমাণ হাজির করে দেখালেন প্রধানমন্ত্রী তথ্য গোপন করছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সংবিধান মোতাবেক এবং মন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশিকা মোতাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবেন; কোনো রকমের প্রভাব বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না।

ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে জোডি উইলসন পদত্যাগ করলেন। লিবারেলদের মাথায় বাজ পড়ল। কারণ প্রকারান্তরে প্রমাণিত হয়ে গেল লিবারেল দলও এসএনসির দুর্নীতির অংশীদার। ৪ ফেব্রুয়ারি অগ্নিতে ঘৃতাহুতি ঘটল স্বাস্থ্য ও আদিবাসী মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে ট্রেজারি বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেইন ফিলপটের পদত্যাগের মাধ্যমে। পেশায় চিকিৎসক ফিলপটের বক্তব্যে লুকোছাপা নেই, কূটনীতিধর্মী দলীয় কথাবার্তা নেই। সৎ স্বীকারোক্তি করলেন, ‘আমার বিশ্বাসের জায়গাটিতে বড়সড় আঘাত এসেছে আমার প্রশাসনেরই এসএনসি-সম্পর্কিত অসংলগ্ন ও অস্পষ্ট অবস্থানের কারণে।’

কানাডায় জোর আলোচনা চলছে প্রতিপক্ষ রক্ষণশীল দল এই সুযোগে ভোটের মাঠ নিজের দখলে নিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে লিবারেল দল ক্ষমতায় আসবে কি না, এলেও কতগুলো আসন হারিয়ে, নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা হারিয়ে আসবে, সেই সমীকরণ চলছে। কেউ কেউ বলছেন ট্রুডোর সম্ভাবনা শেষ, রক্ষণশীলদের আগমনী ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন ফিলপট। মজার বিষয় হচ্ছে, এই বিপজ্জনক সময়েও ফিলপট একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের ডাকে রাস্তায় সমাবেশে হাজির হয়েছেন। ট্রুডোও সেখানে গেছেন। বক্তৃতা করেছেন এবং জেইন যে একজন পরিবেশ অধিকারকর্মী এবং পরিবেশ সংরক্ষণের আন্দোলনে ব্যাপক অবদান রেখেছেন, সেই সব জানিয়ে ভূয়সী প্রশংসাও করলেন।

জনগণের আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক নারীর শিরদাঁড়া প্রসঙ্গ। জনগণের আলোচনায় জিজ্ঞাসাগুলোও বহুমুখী। যেমন এক. ক্ষমতাসীন লিবারেল দল এবং জাস্টিন ট্রুডো বেশি নারীবাদিতা দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়লেন না তো? উল্লেখ্য, ট্রুডো মন্ত্রিসভা গড়েছেন সমানসংখ্যক নারী ও পুরুষ মন্ত্রী নিয়োগের মাধ্যমে। অনেকে বিষয়টিকে দেখেছেন জবরদস্তিমূলকভাবে নারীবাদ প্রদর্শনের চেষ্টা হিসেবে। দুই. রাজনীতিতে ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে ওঠা নারীরা এখনো রাজনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করায় পিছিয়ে থাকলেন না তো? দ্রুত পদত্যাগকে দায়িত্বহীন কাজও তো ভাবা যেতে পারে। পদত্যাগের মাসখানেক আগে জোডি উইলসনকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে ভেটেরানস অ্যাফেয়ার্স (সাবেক সেনাবিষয়ক) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জোডির পদত্যাগ অপছন্দকারীদের কেউ কেউ বলতে চাইছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল পদে বেশ সাফল্য দেখানোর পরও তাঁকে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধপ্রবণ হয়েই তিনি দলকে বিপদে ফেলেছেন।

দুজন মন্ত্রীর হুটহাট পদত্যাগে নারীবিদ্বেষীরা জোর গলায় বলছেন, নারীর বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্য এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতা যে কম, সেই প্রমাণই তো দিয়ে দিলেন দুই নারী রাজনীতিক। কেউ বলছেন এত দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো এবং নিজের সরকারকেই বিপন্ন করে তোলা দিয়েই বোঝা যায় তাঁদের দূরদৃষ্টি কম। লিবারেল দলের অন্ধ সমর্থকদের দু-একজন মিনমিন করে বলতে চাইছেন যে তাঁরা তো পদত্যাগ করেননি দলের পিঠে ছুরি চালিয়ে দিয়েছেন। বিস্ময়ের বিষয়, সাধারণ জনগণ সাংবাদিকদের কাছে ইতিবাচক মতামত দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই তো এই যে রাজনীতিকেরা নীতি-নৈতিকতা প্রসঙ্গে ছাড় দেবেন না, আপস করবেন না। কারণ তাঁদের নির্বাচিতই করা হয়েছে জনগণের এই সব চাওয়া-পাওয়ার রক্ষক হওয়ার জন্য, জনতার চাওয়ার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।

আরেকটি আলোচনাও দ্রুত গতি পাচ্ছে যে, তাঁরা তো প্রমাণ করলেন যোগ্য নারী শিরদাঁড়ায় পুরুষের চেয়েও শক্তিশালী। তাঁরা বরং প্রমাণ করেছেন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ায়, অন্যায়ের কাছে আপস না করায় নারী পুরুষের চেয়ে অগ্রগামী। কই পুরুষ কোনো মন্ত্রী তো পদত্যাগ করলেন না! তাঁদের অনেকের মধ্যেও তো বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তি এবং অননুমোদন-ভাবনা থাকার কথা। ১৯২১ সালের একটি ঘটনাও সামনে আসছে উদাহরণ হিসেবে। প্রায় ১০০ বছর আগে ম্যারি অ্যালেন স্মিথ নামে একজন নারী মন্ত্রী লিবারেল দলে নারী-পুরুষ ক্ষমতা বৈষম্যের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি ছিলেন নারীর ভোটাধিকার ও সম-অধিকার আন্দোলনের কর্মী। নারী বিবেচনায় কিছু জটিল কাজ তাঁর মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়নি (বা অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে) জেনে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।

কানাডার সমাজবিজ্ঞানী-রাজনীতিবিজ্ঞানীদের মতামতও গণমাধ্যমে আসছে। সেগুলোর সারসংক্ষেপ এ রকম—দুই নারী মন্ত্রীর পদত্যাগ অন্তত একটি সত্যকে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে গণতন্ত্র সবচেয়ে নারীবান্ধব রাষ্ট্রপদ্ধতি। গণতান্ত্রিক পরিবেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হলে নারীরা পুরুষ সহকর্মীদের চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে সততাপূর্ণ ও সাহসিকতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। গণতন্ত্র নারীবান্ধব। কারণ নারীর জন্য এই পদ্ধতিই শেষ ভরসা, যেখানে নারীর নারীত্বের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের অপচেষ্টা পুরুষ অপচেষ্টাকারীর জন্য বিপজ্জনক। কেউ কেউ মত দিচ্ছেন, জোডি নারী হওয়ায় ট্রুডোও তাঁকে নাজুক ভেবে থাকতে পারেন এবং পুরুষসুলভ আধিপত্যের মানসিকতা থেকেও এসএনসির জন্য তদবির করে থাকতে পারেন। গণতন্ত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের নিশ্চয়তা থাকাতেই দুই নারী ট্রুডোর অযাচিত পুরুষালি হস্তক্ষেপকে আমলে না নিয়ে সরাসরি নৈতিকতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মানসিক দৃঢ়তা ও সাহস অর্জন করেছেন।

রাজনৈতিক নারীর গণতান্ত্রিক শিরদাঁড়ার এই হাইপোথিসিসটি নিয়ে জেন্ডার অধ্যয়ন বিষয়ে গভীর আলোচনার সুযোগ রয়েছে।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।