প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

এ দেশে বছরের একটি সপ্তাহ বিশেষভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ হিসেবে পালিত হয়। এবারের প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ আমাদের শিশুদের জন্য দু–দুটি আনন্দের সংবাদ বয়ে এনেছে এবং দুটি সংবাদের সঙ্গেই সরকারপ্রধানের আন্তরিকতা ও দূরদৃষ্টির সম্পর্ক রয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের শুরুর দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাকে শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার আহ্বান জানান। শিশু অবস্থাতেই তাদের পড়াশোনার জন্য অতিরিক্ত চাপ না দিতে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি এটুকুই বলব, কোনোমতেই যেন কোমলমতি শিশুদের কোনো অতিরিক্ত চাপ না দেওয়া হয়। তাহলেই দেখবেন তারা ভেতরে একটা আলাদা শক্তি পাবে। আর তাদের শিক্ষার ভিতটা শক্তভাবে তৈরি হবে।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১৩ মার্চ ২০১৯)। একই সঙ্গে তিনি আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে কতগুলো সত্য কথাও বলে দিয়েছেন। অল্প বয়সে লেখাপড়ার কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করাকে ‘একধরনের মানসিক অত্যাচার’ বলে অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘শিশুরা প্রথমে স্কুলে যাবে এবং হাসি–খেলার মধ্য দিয়েই লেখাপড়া করবে। তারা তো আগে থেকেই পড়ে আসবে না, পড়ালেখা শিখতেই তো সে স্কুলে যাবে।’

বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সম্ভবত পৃথিবীতে ব্যতিক্রম, যেখানে শিক্ষকেরা আশা করেন শিশুরা ‘বাড়ির কাজে’ প্রচুর সময় দেবে এবং অনেক কিছুই বাড়িতে শিখে ফেলবে। এমনকি গ্রীষ্মকালীন বা রমজানের ছুটিতেও শিক্ষার্থীদের প্রচুর বাড়ির কাজ দিয়ে দেওয়া হয়, যেগুলোর তেমন কোনো সৃজনশীলতাও থাকে না। অথচ একটু ভাবলে, চিন্তা করলে তাদের ছুটির দিনগুলো যেন আনন্দে কাটে, তারও ব্যবস্থা করা যায়। আমার ছেলের স্কুল থেকে ঈদের ছুটিতে তাকে বিভিন্ন স্থানে বেড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলা হয় ছুটির শেষে সবাই যখন আবার স্কুলে ফেরত আসবে, তখন সবাই নিজ নিজ বেড়ানোর গল্প বলবে। ছেলেকে ‘ঈদের বর্ণাঢ্য’ গল্প বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি ঈদের দিনে শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হামিদুল হক তারিক বীর বিক্রম, ধানমন্ডি লেকের নৌকা চালনাসহ অনেক আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যাই এবং অবাক হয়ে লক্ষ করি সে পূর্বাপর ঘটনাগুলো তার নোট বইয়ে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। আমি পরে জেনেছি ওর ক্লাসের সবাই সেবার নানাভাবে নিজ নিজ ঈদকে বর্ণিল করে তুলেছে।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো সেখানে বছরে তিন–তিনটি পরীক্ষা হয়। অথচ হাইস্কুলেই বছরে দুটি পরীক্ষা। বছরে তিনটি পরীক্ষার কারণে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বছরব্যাপী সিলেবাসকে তিন ভাগে ভাগ করেছে এবং এটি সব শিক্ষার্থীর জন্য একই। প্রাথমিক পর্যায়ে সব শিক্ষার্থী কিন্তু একই গতিতে মূল বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে পারে না। কেউ বেশি সময় নেবে, কেউ কম, এটাই স্বাভাবিক। আবার কোনো কোনো বিষয় বুঝতে বেশি সময় লাগবে সবার, কোনো কোনোটি কম। কিন্তু পরীক্ষার চাপে শিক্ষকদের পক্ষেও এদিকে বাড়তি নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। তাঁরা সিলেবাস শেষ করতেই বেশি আগ্রহ দেখান। ফলে শিক্ষার্থীরা যত না পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়, তাদের জানাশোনার ভিত্তি কিন্তু ততটা মজবুত হয় না। এর সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে সরকার কর্তৃক পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষার্থীর জাতীয় অভীক্ষার ফলাফলে। এটি প্রতি দুই বছর অন্তর পরিচালিত হয়, যেখানে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অভীষ্ট শিখন-ফল (লার্নিং আউটকাম) অর্জন করেছে কি না, তা দেখা হয়।

২০১১ সালের অভীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ বাংলায় তাদের অভীষ্ট শিখন-ফল অর্জন করতে পারে। কিন্তু দুই বছর পরে, ২০১৩ সালে যখন তারা পঞ্চম শ্রেণিতে যাচ্ছে, তখন সে হার কমে হয়ে যাচ্ছে মাত্র ২৫ শতাংশ। গণিতের বেলায় এটি ৫০ শতাংশ থেকে অর্ধেকে কমে এসেছে। একইভাবে ২০১৩ সালের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখন-ফল অর্জনের হার ছিল বাংলায় ৭৫ শতাংশ। অথচ দুই বছর পর, ২০১৫ সালে একই শিক্ষার্থীদের মাত্র ২৩ শতাংশ এই সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছে। গণিতের বেলায় ২০১৩ সালের ৫৭ শতাংশ ব্যাপকভাবে কমে ২০১৫ সালে মাত্র ১০ শতাংশে এসে ঠেকেছে।

তৃতীয় শ্রেণি আর পঞ্চম শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য শুধু একটি—প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নামে পাবলিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ভালো করার জন্য শিক্ষার্থীরা চতুর্থ শ্রেণি থেকেই পরীক্ষার্থীতে পরিণত হয়। আর শিক্ষকেরাও তাঁদের স্কুলের সাফল্য ধরে রাখতে কেবল পরীক্ষার বিষয়গুলোকেই গুরুত্ব দেন। ফলে ‘পরীক্ষায় কী আসবে’ তার কাছে মার খেয়ে যাচ্ছে ‘কী শিখব’। এর থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নামে আমাদের শিশুদের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া। আর এটি বাতিল করার প্রথম পদক্ষেপই হওয়া উচিত প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম তিন বছর স্কুলের আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা রদ করে শ্রেণিকক্ষগুলোতে আনন্দময় করে তোলা, যাতে পড়ুয়ারা পরীক্ষার্থী না হয়ে শিক্ষার্থী হতে পারে।
আর তারই ঘোষণা পাওয়া গেল প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের শেষ দিনে। ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে বুধবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব আকরাম আল হোসেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এই স্তরে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, সেটি ঠিক করা হবে। তবে পরীক্ষা থাকছে না।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ২০ মার্চ ২০১৯)।
গত এক দশকে প্রাথমিক শিক্ষার যতগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। এর ফলে শিক্ষকেরা পরীক্ষার বদলে শিখনে বেশি আগ্রহী যাতে হন, সেটি তদারকি করতে হবে। মন্টেসরির শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করে এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে তার জন্য নানা পদ্ধতি রয়েছে। নতুন করে যেন কোনো পরীক্ষামূলক পদ্ধতি আমাদের প্রাথমিক পড়ুয়াদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়, সেদিকেও যাতে সংশ্লিষ্টদের নজর থাকে তার জন্য অনুরোধ করি।
আশা করি, এ সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাও অচিরেই বাতিল হবে।

মুনির হাসান: গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক