'আমি আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করটেজ'

আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করটেজ। ছবি: রয়টার্স
আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করটেজ। ছবি: রয়টার্স

নিউইয়র্কের প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট জোসেফ ক্রাউলি বাংলাদেশেও পরিচিত নাম। তিনি ‘বাংলাদেশ ককাস’-এ ছিলেন। ফলে এ দেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিবিড়। ঢাকায় রাজনীতিকদের কাছে ও প্রচারমাধ্যমে বরাবরই তিনি গুরুত্বপূর্ণ একজন। তিনি টানা ২০ বছর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে ছিলেন। সেই ক্রাউলিকে প্রথমে নিজ দলের প্রাইমারিতে হারান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও–করটেজ। তারপর জাতীয় নির্বাচনে হারান রিপাবলিকান দলের প্রার্থী অ্যান্টনি পাপ্পাসকে। এভাবেই নভেম্বরে কংগ্রেসে প্রবেশ নিশ্চিত হয় আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও–করটেজের। ক্রাউলি তাঁর চেয়ে ২৮ বছর এবং পাপ্পাস ৪৩ বছরের বড়।

নির্বাচনের শুরুতে ক্রাউলির প্রভাব ভেঙে নিউইয়র্কের বাংলাদেশিদের নজর কাড়তে ওকাসিও–করটেজকে বেশ বেগ পেতে হয়। প্রচারণার সময়
খাঁটি বাংলা উচ্চারণে ‘আমি আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও–করটেজ’ বলে বাংলাভাষীদের সমর্থন চাইতেন। এখন অবশ্য বিশ্বজুড়ে ‘এওসি’ নামেই তাঁকে চেনে সবাই। বাংলাদেশিদের হৃদয়ও জয় করেছেন ইতিমধ্যে।

এওসির উত্থান

নিউইয়র্ক ডেমোক্র্যাট প্রভাবিত জায়গা। ফলে ২৯ বছর বয়সী এওসি যখন এখান থেকে নির্বাচিত হন, তখন বাড়তি মনোযোগ এটুকুই মিলেছিল যে তাঁর বয়স কম। মার্কিন আইনসভায় এত কম বয়সী কারও নির্বাচিত হওয়া বিরল ঘটনা। কিন্তু মাত্র পাঁচ মাস পর চিত্রটি একদম ভিন্ন। বয়স, রং কিংবা মায়াবী চেহারার কারণে নয়—রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে তাঁর প্রতি মনোযোগের পুরো চিত্র পাল্টে নিয়েছেন ওকাসিও-করটেজ।

গত বছর টুইটারে তাঁকে অনুসরণ করেছে ৪৯ হাজার মানুষ। সংখ্যাটা এখন ৩ লাখ ৬৬ হাজার। প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিন ‘দ্য পেনম’ নামে তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ করে জানিয়ে দিল, এওসিকে নিয়ে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা মনোযোগী। কিন্তু এওসি দাঁড়াতে চাইছেন এসব প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষেই। হয়তো সে কারণেই টাইম তাঁকে শ্লেষ করে বলছে, ‘বামদের বিস্ময় নারী’। কিন্তু এ–ও যোগ করেছে, আমেরিকার সমাজে এখন যেসব রাজনীতিবিদকে নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে এওসির অবস্থান ট্রাম্পের পরেই।

এওসি ২০২০-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। যদিও দেশটির সংবিধান অনুযায়ী ৩৫ বছর বয়সের আগে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু এওসির রাজনীতি, দর্শন, প্রথা ভাঙার আকুলতা ইতিমধ্যে ট্রাম্প শিবিরের প্রধান এক প্রতিপক্ষ করে তুলেছে তাঁকে।

পরিবর্তনবাদেরও বিজয় সম্ভব

আমেরিকায় এওসির যখন উত্থান ঘটছে, ঠিক তখন দক্ষিণপন্থীরাই সেখানে নীতিনির্ধারণ করছেন। তাঁদের কাছে রাজনীতিবিদ হিসেবে এওসি অপছন্দের। প্রথম দিকে তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন ‘অল্প বয়সী এক নারী’ মাত্র। তাঁর পুয়ের্তোরিকান পূর্বপুরুষ এবং ‘ডার্ক’ গায়ের রংও তাচ্ছিল্যের বিষয় ছিল। এখন তিনি পুরোদস্তুর ‘ডাইনি’। কিন্তু এওসির আত্মবিশ্বাস বিস্ময়কর। এই তরুণী আসলে বার্নি স্যান্ডার্সের সৃষ্টি। বার্নি ২০১৬ সালে হিলারিকে হারিয়ে ডেমোক্র্যাটদের মনোনয়ন পাননি; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এওসির মতো অনেক তরুণ-তরুণী সৃষ্টি করেছেন, যাঁরা করপোরেট স্বার্থের বিরুদ্ধে এবং মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের স্বার্থের পক্ষে আপসহীনভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। দক্ষিণপন্থী প্রচারমাধ্যম তাঁদের বলছে ‘স্যান্ডার্স আর্মি’। ট্রাম্পের আমলে তাঁদের সংখ্যা ও সক্রিয়তা—দুটোই বাড়ছে। এ রকম তরুণদের একটি সংগঠনের নাম ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকা। ২০১৬ সালে এর সদস্য ছিল ১০ হাজার, আর ২০১৯ সালের শুরুতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার। গত দুই–তিন দশকে অর্থনৈতিক মন্দায় জন্ম নেওয়া তরুণ-তরুণী এঁরা। এওসির বক্তৃতা তাঁদের আকর্ষণ করছে। বার্নির মতো এওসিও বাণিজ্যে গুটিকয়েক বড় কোম্পানির একচেটিয়াত্ব কমাতে আগ্রহী। স্বাস্থ্যসেবাকে সমাজের নিচুতলায় সহজলভ্য করতে চান। বিনা বেতনে কলেজশিক্ষা, অভিবাসন–সংক্রান্ত আইনের মানবিকীকরণ, বাঁচার মতো মজুরি, কার্বণ নিঃসরণ কমাতে, অর্থনৈতিক সংস্কার প্রশ্নেও তাঁদের জনমুখী অবস্থান রয়েছে। বার্নি ও এওসিরা এ–ও মনে করছেন যে রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রত্যেক নাগরিকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা পাওয়া উচিত। তাঁরা এটাকে বলছেন ‘ফেডারেল জব গ্যারান্টি’।

এসব নিয়েই দুই ভাগে বিভক্ত আজকের আমেরিকা। ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ এবং ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’-এর মতো তৃণমূল সংগঠনগুলো একদিকে, করপোরেটরা অন্যদিকে। দ্বিতীয় দলের মূল ভরসা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের প্রভাবশালী নেতারা। বার্নি ও এওসির মতো চরিত্রদের লড়তে হচ্ছে একই সঙ্গে রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে এবং ডেমোক্রেটিক দলের দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধেও। ‘স্থিতিশীলতা’র পক্ষের প্রতিষ্ঠানপন্থী রাজনীতিবিদদের প্রচারমাধ্যম ‘মধ্যপন্থী’ বলে। আর যাঁরা পরিবর্তনের কথা বলেন, তাঁদের তকমা দেয় ‘বামপন্থী’ হিসেবে। বামপন্থীদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের মিডিয়া-ইমেজ।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তরুণেরা ক্রমে আর তথাকথিত মধ্যপন্থায় আস্থা রাখছেন না। এওসির উত্থান এই তরুণদের সামনে এক দৃষ্টান্ত হাজির করেছে—পরিবর্তনবাদেরও বিজয় সম্ভব!

আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচন

ক্রাউলি যখন প্রথম নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচন শুরু করেন, ওকাসিও-করটেজ তখন প্রাথমিকের ছাত্রী মাত্র। স্পষ্টত, নবীন ডেমোক্র্যাটরা তারকা নেতাদের চেয়ে আদর্শিক তরুণ-তরুণীদের রাজনীতিবিদ হিসেবে খুঁজছে। ফলে বিভিন্ন অস্বচ্ছ উৎস থেকে নির্বাচনী খরচ পেতে অভ্যস্ত রাজনীতিবিদেরা অর্থ জোগানদাতাদের স্বার্থ ও জনস্বার্থের টানাপোড়েনে পড়ছেন। এওসি মনে করেন, আমেরিকার রাজনীতিতে অর্থের দাপট অর্থ দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। জনস্বার্থের প্রচার দিয়ে করতে হবে। এই কৌশল কাজ করছে।

তবে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় বাধাও আছে। এওসির মতো আদর্শবাদীদের বিরুদ্ধে সাদা-দক্ষিণপন্থার জাগরণ ঘটানো হচ্ছে। রিপাবলিকানদের একাংশ মনে করে, অশ্বেতাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী-তরুণদের রাজনৈতিক উত্থান ঠেকাতে সাদা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার প্রসার জরুরি। পাশাপাশি বামভীতি ছড়াতে হবে। এই কাজে ফক্স নিউজসহ প্রভাবশালী প্রচারমাধ্যমের সহায়তা আছে রিপাবলিকানদের জন্য।

এওসি রিপাবলিকান ট্রাম্পদের এক আপসহীন প্রতিপক্ষ। তবে তিনি মনে করেন না ট্রাম্পকে হারালেই সমাজের দক্ষিণপন্থী শক্তিকে হারানো হবে। হিলারির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বার্নি ঠিক এটাই বলতেন। আমেরিকার এই নতুন রাজনীতিবিদেরা নির্বাচন করছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে। শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের গভীরে বিস্তৃত সমস্যার সমাধান দিতে পারছে না বলেই বার্নি স্যান্ডার্সের অনুসারীদের এই রণকৌশল। এওসির বক্তৃতার স্টাইল ও বিষয়বস্তু বলে দেয়, নির্বাচনে জয়ের চেয়েও তিনি চাইছেন শ্রোতার হৃদয় জয় করতে। তবে ডেমোক্র্যাটদের প্রভাবশালী অংশ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা চটাতে চায় না, যা নির্বাচনে বিজয়কে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বার্নি ও এওসিরা এ রকম ‘প্রতিষ্ঠান-ভীতি’ থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে চান, ব্রিটেনে যা চাইছেন জেরেমি করবিন। কাজটি সহজ নয়।

‘হাল ছেড়ো না’

এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেখানে অসমতাও বিপুল। এমনও রয়েছে একটি পরিবারের সম্পদের পরিমাণ নিচতলার প্রায় ১৩ কোটি মানুষের সম্পদের সমান। ওয়াল-মার্টের ওয়ালটন পরিবারের মতো মাত্র চার শ জনের হাতে নিচতলার ৬০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের সমান সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সামাজিক নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয় সহায়তার জন্য এ রকম অতি ধনীদের ওপর এখন বাড়তি কর আরোপ করা প্রয়োজন। কিন্তু ধনীরা চাইছে ‘স্থিতিশীলতা’ চলুক। শুধু রিপাবলিকান নয়, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও স্থিতিশীলতার পক্ষে সমর্থক আছে অনেক। ২০১৬ সালের নির্বাচন-পূর্ব সময়ে স্যান্ডার্স এই স্থিতিশীলতায় শরীরে মৃদু ঝাঁকুনি দেন। প্রতিপক্ষ তাঁকে ততোধিক সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিল।

এই স্থিতিশীলতার সুরক্ষার জন্যই সাদা-শ্রেষ্ঠত্বের চেতনা এসেছে। ট্রাম্পও সেখানেই আশ্রয় নিয়েছেন এবং দেশজুড়ে একধরনের জরুরি অবস্থা কায়েম করতে পেরেছেন। এদের হয়েই বড় বড় প্রচারমাধ্যম পরিবর্তনবাদীদের নিয়ে ভীতি ছড়াচ্ছে। এওসিও তাদের একজন টার্গেট।

‘ট্রুথডিগ’-এর এক অনুসন্ধানে বেরিয়েছে, নির্বাচনের পর প্রথম ১৩৪ দিনে ফক্সের ১ হাজার ১৭৩টি ‘স্টোরি’তে এওসির উল্লেখ ছিল। এওসিকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয় এসব প্রতিবেদনে। এত সব প্রচারণা সত্ত্বেও নিজ আদর্শ নিয়ে এওসি হীনম্মন্যতায় ভোগেন না। টুইটার খুললেই দেখা মেলে তাঁর প্রিয় উক্তি, ‘হাল ছেড়ো না।’ বাংলাদেশও নিশ্চয়ই এমন দৃঢ়চেতা কোনো তরুণীকে পাবে একদিন।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক