হচ্ছে, হবে, কিন্তু কবে?

গত ১৮ মার্চ প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘আদালতের বাইরে বিরোধ মিটলে সময় ও খরচ বাঁচে’ শিরোনামে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকার শেষ হয়েছে ১১ পাতায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রথম আলোর মিজানুর রহমান খান। তাঁর প্রশ্নগুলো ছিল আইন অঙ্গনের বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে। কিন্তু আইনমন্ত্রীর উত্তরের মধ্যে প্রধানত ছিল পুরোনো বুলি। সমস্যা সমাধানে আশার আলো দেখিনি, পড়ে হতাশ হয়েছি।

স্বভাবতই সাক্ষাৎকারের আলোচনার প্রথম বিষয় ছিল আদালতে মামলাজট। অপেক্ষমাণ মামলার সংখ্যা গত পাঁচ বছরে বেশ বেড়েছে। আইনমন্ত্রী এর সমাধান হিসেবে আবারও বললেন এডিআর। অর্থাৎ, মামলা দায়েরের পর আদালতের অনুমতি বা নির্দেশে আদালতের বাইরে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে সালিস বৈঠক করে মামলার ব্যাপারে একটা নিষ্পত্তিমূলক সমাধানে পৌঁছাই হলো এডিআর। যতদূর মনে পড়ে, শফিক স্যার (ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ) তাঁর মন্ত্রিত্বের পাঁচ বছরে (২০০৯-১৪) সবচেয়ে বেশি কথা এবং আইনজীবী ও অন্যদের মিটিং-আলোচনা-সভায় উল্লেখ করেছিলেন এই সালিস প্রথার প্রয়োজনীয়তা ও উৎকর্ষ। বর্তমান আইনমন্ত্রীও সেই পথ থেকে স্পষ্টতই বিচ্যুত হননি। কিন্তু আমাদের ধারণা, সরকারের এক দশক ধরে এত চেষ্টার পরও সালিস প্রথায় খুব বেশি সাফল্য আসেনি এবং আসার সম্ভাবনাও কম। কেন সালিস প্রথায় মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না, গলদটা কোথায় এবং কোন ধরনের সালিসি ব্যবস্থায় সাফল্য আসবে—এ নিয়ে বাস্তবধর্মী গবেষণা করে গবেষণাপ্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত, তাহলে ফল আসত। কিন্তু গবেষণা করা মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। মন্ত্রণালয় পারে হুকুম বা নির্দেশ দিতে। এতে কাজ হয়নি, নিকট ভবিষ্যতেও হবে না।

সরকার আইন পরিবর্তন করে জেলা আদালতে বিভিন্ন স্তরে আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়েছিল। কথার কথা, সহকারী বিচারকের আদালতে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিরোধের মীমাংসা হতো। আর্থিক এখতিয়ার ২ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বাড়ানো হলো। একইভাবে সিনিয়র সহকারী বিচারকের এখতিয়ার বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৫০ লাখ বা ১ কোটি টাকা। সঠিক অঙ্কটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কিন্তু মোদ্দাকথা ছিল, অনেক স্তরের বিচারকদের আর্থিক এখতিয়ার বৃদ্ধি করা হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টে রিট মামলা করার কারণে এটা আটকে গেল। যত দোষ নন্দ ঘোষের। আইনমন্ত্রী দুষলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে। বিচারপতি সিনহার প্ররোচনায় নাকি এই আর্থিক এখতিয়ার বৃদ্ধিটা উচ্চতর আদালত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নিম্ন আদালতে আর্থিক এখতিয়ার বৃদ্ধি করে যদি বিচারপ্রার্থীর বিচার পাওয়া সহজতর হয়, তাহলে সেই যুক্তিগুলো উচ্চতর আদালতে তুলে ধরে আর্থিক এখতিয়ার বৃদ্ধির পক্ষে তো রায় পাওয়া যেত। সরকার সেই পথে হেঁটেছে বলে মনে হয় না।

বড় কথা হলো, বাড়ছে ফৌজদারি মামলা। দেওয়ানি মামলা বেশি হারে বাড়ার খবর পাওয়া যায়নি। আর ফৌজদারি মামলা যে বাড়ছে, সেটা যাঁরা পত্রিকা পড়েন, তাঁরা সবাই সহজে অনুমান করতে পারেন। ইদানীং হাইকোর্টে আগাম জামিনের জন্য দূরদূরান্ত থেকে আসা শত শত সাধারণ বিচারপ্রার্থীর করুণ ছবি পত্রিকার পাতায় অনেকেই দেখেছেন। ফৌজদারি মামলা বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা এখন সরকারের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে গেছে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের একটা বাক্যের জন্য আমাদের বিচারব্যবস্থায় যোগ হয়েছিল ২২টি ফৌজদারি মামলা। সত্যিকার মামলা হতে পারত ১টি। বাকি ২১টি?

হাইকোর্ট জামিন দেওয়ার পর সেই জামিন আদেশ বাতিল করার জন্য সরকার প্রায় সব ক্ষেত্রেই আপিল বিভাগে গিয়ে আপিল করে। ইদানীংকালের তুলনায় অতীতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত; অর্থাৎ আপিল বিভাগে এত বেশি জামিন মামলা সম্ভবত করা হয়নি। এর দায়ভার সম্পূর্ণ সরকারের। এসব মামলাজটের সঙ্গে সালিস বা আর্থিক এখতিয়ারের কোনো সম্পর্ক নেই।

এরপরের আলোচনার প্রসঙ্গ ছিল ই-জুডিশিয়ারি। যত দূর বুঝেছি তা হলো, আইনমন্ত্রী বলতে চেয়েছেন ঘরে, চেম্বারে বা জেলে বসে লোকজন আদালত বরাবর ই-মেইল পাঠিয়ে মামলা করতে পারবে। সশরীরে আর আদালতে হাজির হতে হবে না। যত দূর মনে পড়ে, বছর দশেক আগে সিঙ্গাপুরে এই ব্যবস্থা দেখে এসেছিলাম। ধারণা করছি, মন্ত্রী মহোদয়ও উন্নত বিশ্বের কোথাও কোথাও বিচারকার্যে ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছেন। আমরা এখন পর্যন্ত সমন জারির সমস্যা বা সাক্ষী আদালতে হাজির করার মতো ভয়ংকর জটিল কাজটার কোনো সুরাহা করতে পারিনি। তাই ই-জুডিশিয়ারির কথা আরও এক দশক পরে চিন্তা করলে সুফল আসতে পারে।

আইন ক্যাডার ছাড়া আইন অনুযায়ী দেশ শাসন সম্ভব নয়। কিন্তু প্রায় ৫০ বছর হতে চলল, আমরা এখনো আইন ক্যাডার বা সরকারের আইন কর্মকর্তা নিয়োগে একটা স্থায়ী ও সুদীর্ঘ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রথম পদক্ষেপটিও নিতে পারিনি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বহু বছর ধরে নিয়মকানুন মেনে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্থায়ী পদে নিয়োগ পাচ্ছেন। সরকারের গার্ড বা গাড়িচালক থেকে শুরু করে উচ্চতর পদের জ্যেষ্ঠ সচিব পর্যন্ত সবাই একটা প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে সরকার ও দেশকে সেবা দেয়। কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয়ে নিজস্ব আইন কর্মকর্তা আছে বলে শুনিনি। মন্ত্রণালয়গুলোতে কিছু পদ আছে, যেখানে নিম্ন আদালতের বিচারকেরা তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য প্রেষণে আসেন আর মেয়াদ পূর্তিতে তাঁদের বিচারক পদে ফিরে যান।

দুনিয়ার বোধ হয় বেশির ভাগ দেশেই সরকারের হয়ে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করার জন্য স্থায়ী প্রসিকিউটর থাকে। অন্যান্য সরকারি পদের মতো প্রথমে সহকারী প্রসিকিউটর, তারপর সিনিয়র সহকারী প্রসিকিউটর। এরপর উপ বা যুগ্ম প্রসিকিউটর হিসেবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যান। আমাদের বিচারব্যবস্থায় সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় বা ফৌজদারি মামলায় শেষতক শতকরা ৯০ জন অভিযুক্তের খালাস পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো স্থায়ী আইন ক্যাডারের অভাব। আমাদের পরিবেশ আদালত আছে, পরিবেশ আইন আছে, পরিবেশ অধিদপ্তর আছে এবং আছে পরিবেশদূষণ। কিন্তু দূষণকারীর বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য সরকারের কোনো স্থায়ী ও নির্দিষ্ট আইন কর্মকর্তা; অর্থাৎ আইনজীবী নেই।

নিকট অতীতে যত সরকার এসেছে, তাদের সবাই স্থায়ী ক্যাডারের ব্যাপারে করব, করছি—এই গোছের বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে প্রায় দুই দশক ধরে। তবে সরকারের পক্ষে জিন্দাবাদ বা জয় বাংলা স্লোগান দেওয়া আইনজীবীদের সাময়িকভাবে কোনো পদ দেওয়ার রাস্তাটা বন্ধ হয়ে যাবে, যদি আইন ক্যাডারব্যবস্থা চালু হয়। রাষ্ট্র জাহান্নামে যাক, আমাদের দলীয় আইনজীবীদের জন্য কিছু পদ ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা সমুন্নত রাখাই মূল মন্ত্র। তাই এবারও বর্তমান মন্ত্রী আবারও বললেন, হবে, হচ্ছে।

একই কারণে বিচারপতি নিয়োগের আইন হচ্ছে না। আশপাশের সব দেশেই আছে, শুধু আমাদের দেশে নেই। কেউই দাবি করে না যে, আইন থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু অন্যদিকে, অনেক সমস্যার সমাধান হয় এবং বিচার বিভাগে স্বাধীনতা আরও সমুন্নত হয় বিধায় আশপাশের সব রাষ্ট্রেই বিচারপতি নিয়োগের আইন আছে। সম্ভবত বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের বাসনা ও কামনা থেকেই আমাদের রাষ্ট্র এখনো এই আইন প্রণয়ন করেনি। তাই অতীতের আইনমন্ত্রীদের মতো আনিসুল হকও বললেন, হবে, হচ্ছে।

আরও ভালো কিছু আশা করেছিলাম। অন্তত কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের প্রতিজ্ঞা। পাইনি। হতাশ হয়েছি।

ড. শাহদীন মালিক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক