বৃষ্টি গেছে, গেছে দোলাও

চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে জীবন গেছে বৃষ্টি ও দোলার
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে জীবন গেছে বৃষ্টি ও দোলার

বৃষ্টিও গেছে দোলাও গেছে, একই সঙ্গে। তারা দুই বান্ধবী, স্কুল–কলেজ পার হয়েছে; ভর্তি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, আলাদা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু বন্ধুত্ব ঘোচেনি। থাকত তারা কাছাকাছি বাসাতেই, ঢাকা শহরের লালবাগে। স্কুলে পড়েছে একসঙ্গে, কলেজেও তা–ই; তার পরে আর একসঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। তা ও রকম বিচ্ছেদ তো ঘটেই। তারা একসঙ্গে থাকতে ভালোবাসত, একসঙ্গেই বাসায় ফিরছিল, রিকশায় করে, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। দুজনেই মারা গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে। দুজনের কাউকেই আর চেনার উপায় ছিল না, পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। মা–বাবা পাগলের মতো খুঁজেছেন, খুঁজে পাননি; শেষ পর্যন্ত পেলেন, ৭০ জন মৃতের ভেতর।

রাতের বেলায় রিকশায় করে বাসায় ফেরার পথে দুটি মেয়ে পথে হারিয়ে গেছে, সেটা আমাদের এই ঢাকা শহরে, তথা গোটা বাংলাদেশেই কোনো অস্বাভাবিক খবর নয়। হারাচ্ছেই তো। প্রতিনিয়ত। বিপদ তাদের পদে পদে। ছেলেরাও অবশ্য নিরাপদে নেই। আবার শিশুরাও মারা পড়ছে হরহামেশাই, খেলতে গেলে খোলা ড্রেনে পড়ে হারিয়ে যায়, বস্তিতে আগুন লাগলে পুড়ে কয়লা হয়। ভাষানটেকে আগুন লেগেছিল ফেব্রুয়ারি মাসেরই ২৮ তারিখে, এক হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে, দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে দুটি শিশু। বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগে মারা গেছেন ২৬ জন। এরপর পুড়ে গেল গুলশান মার্কেটও।

এমনটা হামেশাই ঘটছে। মেয়েশিশু হলে ধর্ষিতও হয়। যেখানে–সেখানে ধর্ষণের পরে আবার তাদের হত্যাও করা হয়। একাত্তরের ৯ মাসে বাংলাদেশের মেয়েরা, মেয়েদের মা–বোনেরা, অভিভাবকেরা, অপরিচিত শব্দ শুনলেই আতঙ্কে চমকে উঠত, ওই বুঝি হানাদার এল, বন্দুকধারী। সেসব দিনে নারী নির্যাতনের কোনো অবধি ছিল না। কিন্তু হানাদার ইবলিশও শিশু ধর্ষণ করেছে বলে শোনা যায়নি, এখন বাঙালিদের স্বাধীন রাজত্বে যেমনটা প্রতিদিন শুনতে হচ্ছে। না, জনশ্রুতি নয়, তথ্যপ্রমাণসহ বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। বৃষ্টি ও দোলা ঘরে ফেরেনি, এ খবর তাদের পিতা–মাতাদের বুকে কেমন কঠিন আঘাত হেনেছে, সেটা ধারণা করার জন্য সবিশেষ অনুমান-শক্তির দরকার পড়ে না, অতি সহজে টের পাওয়া যায়। মেয়ে দুটি অপহৃত হয়েছে—এমনটাই মনে করা হয়েছিল প্রথমে; যেমনটা মনে করা স্বাভাবিক। এর মধ্যে প্রতারকেরা ফোন করেছে দুজনের মা-বাবাকে, মোবাইল ফোনের নম্বর সংগ্রহ করে, কোন দক্ষতায় করল বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন; ফোন করে মুক্তিপণও আদায় করেছে, আংশিক। কিন্তু যে সত্যটা বৃষ্টি ও দোলার মা-বাবা কিছুতেই মেনে নিতে চাননি। সত্য তো সেটাই, মেয়ে দুটি আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেছে।

এদের অপরাধটা কী? তাদেরই বা অপরাধটা কী ছিল অগ্নিকাণ্ডে অন্য যারা দগ্ধ হয়েছে? ৯ বছর আগে একই ধরনের ও একই কারণে তৈরি ওই চুড়িহাট্টার কাছেই নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে যে ১২৪ জন প্রাণ দিয়েছে, তাদেরই বা কী ছিল অপরাধ? একটা সাধারণ অপরাধ অবশ্য এই যে তারা এ দেশে জন্মেছে এবং প্রাণপণে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। সে অপরাধে অবশ্য আমরা সবাই অপরাধী।

তবে হ্যাঁ, অতিরিক্ত দুটি অপরাধ বৃষ্টি ও দোলা করে ফেলেছিল। প্রথমত, তারা জন্মেছিল নারী হিসেবে। সেটা কোনো মতেই তাদের গুণ নয়, পুরোপুরি দোষ। তবে এর জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়। কিন্তু তারা অবশ্যই অন্য একটি অপরাধের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী। সেটা হলো, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করা। দুজনেই ওই কাজটা করত। একেবারে শৈশব থেকেই। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখেও তারা শিল্প-সংস্কৃতির টানেই ঘর থেকে বের হয়েছিল। গিয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। আবৃত্তি অনুষ্ঠানে অংশ নেবে বলে। অংশ নিয়েছিলও। বোঝা যাচ্ছে, কাজটা করতে যাওয়া তাদের জন্য উচিত হয়নি। তাহলে কী করা উচিত ছিল? শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা না করা? আপনি বলবেন চর্চা করবে না কেন, পাড়া-মহল্লার ভেতরেই সেটা করা ঠিক ছিল, অত দূরে না গিয়ে। কিন্তু পাড়া-মহল্লায় কি শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার কোনো সুযোগ আছে? আছে কি সামান্যতম ব্যবস্থা? ঢাকা শহরে কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করা হয়েছিল কয়েকটা, খুব অল্পসংখ্যকই। কিন্তু সেগুলোও এখন অনেক কিছুর জন্যই কাজে লাগে, এক শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ছাড়া। বিয়ে, বউভাত, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী—এসবের জন্য এগুলো ভালোই উপযোগী। রাজধানীতে এখন সাংস্কৃতিক সংঘ নেই, পাঠাগার নেই, খোলা মাঠ নেই। তাহলে মেয়ে দুটি কী করবে?

কেন, ঘরে বসে ফেসবুক, ইন্টারনেট এসব নিয়ে নাড়াচাড়া করবে; মোবাইলে কথা বলবে, দরকার হলে অবিরাম। ভিডিও গেমসও তো আছে। আমাদের একজন বিশেষজ্ঞ মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, শিশুরা যদি শৈশবেই ভিডিও গেমস খেলা ধরে ফেলে তাহলে আর কোনো কথা নেই, তাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশকে কেউই দাবিয়ে রাখতে পারবে না, আমাদের ডিজিটাল হওয়ার ব্যাপারটা একেবারেই নিশ্ছিদ্র হয়ে যাবে। মনে হয় ডিজিটাল হতে আর আমাদের খুব একটা দেরি নেই। মেয়ে দুটির অপরাধ তারা ডিজিটাল হতে সম্মত হয়নি, মানুষের মতো হতে চেয়েছিল। এ কাজটা বর্তমান বিশ্বে চাওয়াটা ভীষণ অন্যায়। এমনকি মহান চীন, একদিন যে আমাদের বিপ্লবের সুস্পষ্ট পথ বাতলে দিত, সে–ও তো দেখা যাচ্ছে এখন আর বসে নেই, লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নতির চরম শিখরে উঠে যাচ্ছে, মানুষের ওপর ভরসা না রেখে চীন এখন অভিনব সব যন্ত্র উদ্ভাবনের তালে আছে। চীন একসময়ে আমেরিকার শত্রুপক্ষ ছিল বৈপ্লবিক মতাদর্শের কারণে, এখনো আমেরিকার জন্য হুমকিস্বরূপই হয়ে রয়েছে পুঁজিবাদী উন্নতির ধারাতে; আমেরিকাকে সে হারাবে কেবল বাণিজ্যযুদ্ধে নয়, প্রযুক্তিযুদ্ধেও। আমেরিকানরা ড্রোন ব্যবহার করছে যুদ্ধক্ষেত্রে, চীন রোবট ব্যবহার করতে চলেছে রোজকার কাজকর্মে, এমনকি টেলিভিশনে খবর পড়া, সে কাজও রোবট তাদের সাহায্য করবে বলে আভাস দিয়েছে। মানুষকে কোণঠাসা করতে থাকবে চীন ও আমেরিকা উভয় পক্ষই। প্রতিযোগিতামূলকভাবে। কেবল কোণঠাসা নয়, মানুষের মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধেও লিপ্ত হবে।

বৃষ্টি ও দোলার অপরাধ তো দেখা যাচ্ছে ওই কোণঠাসা এবং যান্ত্রিক হতে অসম্মত হওয়াটাই। বেচারারা ভেবেছিল মানুষের মতো বিকশিত হবে এবং বাঁচবে। মা–বাবা নিষেধ করেননি; ধারণা করি তাঁরা উত্সাহই দিয়েছেন। মেয়ে দুটি নইলে সংস্কৃতিচর্চাটা অব্যাহত রেখেছিল কী করে? কিন্তু সমাজ চায়নি, সমাজ চায় না, সমাজ এখন ঘরে বসে সিরিয়াল দেখে, লুকিয়ে মাদক সেবন করে এবং ডিজিটালে পরিণত হয়। সংস্কৃতিচর্চা রাষ্ট্র যে চায়, এমনও তো বলতে পারছি না। তনুর কথা মনে আছে তো? সেই যে মেয়েটি, অভিনয় করত, আবৃত্তি করত, পড়ত কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে, বাসা ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায়। মঞ্চে তাকে দেখা যেত। চটপটে, প্রাণবন্ত মেয়ে। চোখে পড়ত। প্রাণবন্ত হওয়ার অপরাধেই প্রাণ দিয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে এবং নিহতও। রাষ্ট্র কোনো বিচার করেনি। তিন বছর পার হয়ে গেল, তদন্ত এগোল না। এক কদম এগিয়েছে তো পিছিয়ে গেছে দুই কদম। তনুর অসহায় মা–বাবা; তাঁরা কার কাছেই–বা বিচার চাইবেন, এক আল্লাহ ছাড়া? বিচার চাইছেন তাঁর কাছেই।

আইনের শাসন চাই, আইনের শাসন চাই; বলতে বলতে যাঁরা ক্লান্ত হন না, তাঁদের সাধুবাদ জানাই, তাঁদের কামনা সফল হোক—এটা কায়মনোবাক্যে কামনা করি। আইনের শাসন পাওয়া গেলে আমাদের সবারই লাভ। কিন্তু পাওয়া যাবে কি? ভরসা করার কারণ তো দেখি না। কিছুদিন আগেই তো খবর পাওয়া গেল যে বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে ১২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১১২তম স্থানে। গত বছর অবস্থান ছিল ১০২-এর স্তরে। (আমাদের সময়, ৩ মার্চ ২০১৯) অর্থাৎ এক বছরে ১০ ধাপ নিচে নেমেছি আমরা। নেমেছি যে সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। খুন, গুম, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণ—এসব তো নিত্যদিনের ঘটনা। কে কার বিচার করে? কোথায় জবাবদিহি? কার কাছে? নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ কম হয়নি; দেশব্যাপী প্রবল ও ধারাবাহিক প্রতিবাদের মুখে অপরাধী চিহ্নিতও হয়েছে, কিন্তু বিচার হয়েছে কি? ছয় বছর হয়ে গেল, তদন্তই শেষ হচ্ছে না। সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার সময় তো কেবল বাড়ছেই, যেন দ্রৌপদীর শাড়ি; কবে যে শেষ হবে, কেউ জানে না। অদৃশ্য দেবতারা তো মনে হয় খুনিদেরই সৎমানুষ ভেবে বসে আছেন, তদন্ত তাঁরা ঠেকাবেনই, যত দিন পারেন। এই লেখাটা লিখতে লিখতেই খবরের কাগজে পড়ছি সাড়ে ১৫ মাস পরে অপহৃত একজন সাবেক কূটনীতিক ঘরে ফিরে এসেছেন। এত দিন কোথায় ছিলেন, কেউ জানে না, জানা যাবে বলেও মনে হয় না। পুলিশ তো জানেই না। পুলিশ বরং অপহৃতের কাছেই জানতে চাইছে কী করে তিনি ঘরে ফিরলেন। অপহৃতই কি আসলে অপরাধী? গা ঢাকা দিয়েছিলেন? পুলিশকে বিব্রত করতে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক