কালবৈশাখীর মৌসুম

রোববার সন্ধ্যায় হঠাৎ প্রবল এক ঝড় এসে জানিয়ে দিয়ে গেল, আমরা কালবৈশাখীর মৌসুমে প্রবেশ করেছি। এক মিনিটের কিছু বেশি সময় ধরে ঘণ্টায় ৭৪ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো বাতাস বয়ে গেছে। রাজধানী ঢাকায় তিনজনসহ সারা দেশে ছয়জন মানুষ নিহত হয়েছেন। রাজধানীর অন্তত ২৫টি জায়গায় গাছ উপড়ে পড়েছে ও ডালপালা ভেঙেছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি হেলে পড়ে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সড়কের ওপর গাছ ও গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ায় অনেক এলাকায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। সৃষ্টি হয়েছে যানজট।

এ ধরনের আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে মানুষের অসহায়ত্ব বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালিপনার ওপর মানুষের কোনো হাত নেই—এ রকম নিয়তিবাদী মনোভঙ্গি পোষণ করে নির্বিকার থাকাও কোনো কাজের কথা নয়। কারণ, মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধতার মুখে পুরোপুরি নিরুপায় নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি যেন ন্যূনতম মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, অন্তত মানুষের মৃত্যু যেন এড়ানো যায়, সে রকম চেষ্টা অবশ্যই করা যায়।

প্রথমত, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস সময় থাকতেই জাতীয় সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা উচিত এবং জনসাধারণের উচিত সেই পূর্বাভাসকে অবহেলা না করে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া এবং যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা। আমাদের দেশে উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে। রোববারের কালবৈশাখীর পূর্বাভাস তেমনভাবে প্রচার করা হয়নি, যদিও বিকেল পাঁচটার দিকে বেসরকারি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী কিছু সংস্থার সূত্রে ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু মানুষ জানতে পেরেছিল যে একটি ‘স্ট্রং উইন্ড’ বা প্রবল বাতাস ধেয়ে আসছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের পূর্বাভাস দেশবাসীকে অঞ্চল ভিত্তিতে জানানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। এটা করা গেলে বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই সেই সময়টা অন্তত এড়াতে পারবেন।

রোববারের ঝড়ে ঢাকায় যে তিন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দুজনই নিহত হয়েছেন ভবন থেকে খসে পড়া ইটের আঘাতে। একজন পল্টন এলাকায়, অন্যজন মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায়। সুনির্মিত ইমারতের ইট ঝোড়ো বাতাসে খসে পড়ার ঘটনা স্বাভাবিক নয়, নির্মীয়মাণ ইমারত থেকে তা ঘটতে পারে। যে দুটি ভবন থেকে ইট পড়ে ওই দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, সেগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। কিন্তু তা এখনো করা হয়নি বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। নির্মীয়মাণ ইমারত থেকে ইট পড়ে থাকলে অবশ্যই ইমারত দুটির মালিকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এই সুবাদে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন সুরক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেন ইট বা অন্য কোনো নির্মাণসামগ্রীর আঘাতে মানুষ হতাহত না হয়।

ঢাকায় নিহত তৃতীয় ব্যক্তি একজন নারী, তিনি নিহত হয়েছেন ফুটপাতের ওপর উপড়ে পড়া গাছের নিচে চাপা পড়ে। ঝড়ের সময় সড়ক ও ফুটপাতে গাছ উপড়ে পড়া কিংবা গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মানুষের হতাহত হওয়া একটি ভীতিপ্রদ সমস্যা। এই সমস্যা অনেক পুরোনো, কিন্তু এর সমাধানের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয় না। প্রচুর ডালপালা ছড়ায় এমন বড় বৃক্ষ সড়কের পাশে লাগানো উচিত নয়, পাম বা দেবদারুজাতীয় গাছ, ছোট ছোট ফুলগাছ ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী ঝোপজাতীয় উদ্ভিদ লাগানো উচিত। শহরের ভেতরে সড়কের পাশে ও সড়কদ্বীপে গাছপালা লাগানোর ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সড়কের পাশে যেসব পুরোনো বড় বৃক্ষের শিকড় দুর্বল হয়েছে, ঝড়ে যেগুলোর উপড়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে কী করা যায়, সে বিষয়েও নগরে গাছ লাগানোর বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে উভয় সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।