তালেবানের ভাবমূর্তি উন্নত করছে যুক্তরাষ্ট্র?

খোদ আমেরিকার সুপারিশে পাকিস্তান সরকার গত বছর মোল্লা বারাদারকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
খোদ আমেরিকার সুপারিশে পাকিস্তান সরকার গত বছর মোল্লা বারাদারকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

সিআইএ এবং আইএসআই যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে করাচির উপকণ্ঠ থেকে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ধরেছিল। তিনি আফগান তালেবানের সেকেন্ড ইন কমান্ড মোল্লা বারাদার। তাঁর গ্রেপ্তারকে ওবামা প্রশাসন তখন আফগানিস্তানে চলা যুদ্ধের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে আখ্যা দিয়েছিল। তালেবানের বিরুদ্ধে যখন সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছিল, তখন তিনি গারদে বন্দিজীবন কাটাচ্ছিলেন।

ইতিহাসের কী বিস্ময়কর কূটাভাস, ৯ বছর পর তালেবানের সেই সেকেন্ড ইন কমান্ড মোল্লা বারাদারকে আমরা দোহা বৈঠকে আমেরিকান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে আলাপ–আলোচনা করতে দেখলাম। সেখানে তালেবান প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। আফগানিস্তান থেকে কবে নাগাদ মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়া হবে, তার দিনক্ষণ ঠিক করার ইস্যুতে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে দেনদরবার চলছে, তা ঠিক করা অনেকটাই মোল্লা বারাদারের ওপর নির্ভর করছে। খোদ আমেরিকার সুপারিশে পাকিস্তান সরকার গত বছর মোল্লা বারাদারকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

মোল্লা বারাদার তালেবান আন্দোলনের একজন অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা। ১৮ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসানে তাঁর ভূমিকাকে এখন খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন কারাবরণ করায় তালেবানের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে তাঁকে অনেক শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর তিনিই কার্যত তালেবান আন্দোলনের প্রধান। মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বারাদারের উপস্থিতি তালেবান প্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে 

মনে করা হচ্ছে। শান্তি আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তার সুবাদে সবার মনে এই আশাবাদ জাগছে যে যুদ্ধ থামাতে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হলেও হতে পারে। দোহা বৈঠকে তালেবান প্রতিনিধিদের মধ্যে আরও এমন পাঁচজন প্রতিনিধি ছিলেন, যাঁরা দীর্ঘদিন গুয়ানতানামোর কারাগারে কাটিয়েছেন। যে আমেরিকানরা তাঁদের নির্যাতন করেছেন, তাঁদের সঙ্গেই এক টেবিলে বসে তাঁরা আলোচনা করেছেন। ২০১৪ সালে তালেবানের হাতে ধরা পড়া একজন আমেরিকান সেনাকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে এই তালেবান নেতাদের গুয়ানতানামো কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই তাঁরা দোহায় বসবাস করছেন। তাঁরা সবাই মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এই তালেবান নেতারা আবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টিসীমানায় চলে আসেন। এই আলোচক দলে তাঁদের অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে তালেবান ওয়াশিংটনকে একটি বার্তা দিতে চায়। আমেরিকান প্রতিনিধিদলের প্রধান জালমে খলিলজাদ এই আলোচকদের ‘আগের চেয়ে বেশি কর্তৃত্বসম্পন্ন’ নেতা বলে উল্লেখ করেছেন।

১৩ বছর ধরে কারাগারে থেকে অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করার পরও বৈঠকে যোগ দেওয়া তালেবান নেতাদের চেহারা বা অভিব্যক্তিতে মুষড়ে পড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। গুয়ানতানামো–ফেরত তালেবান আলোচক মোল্লা খায়েরখোয়া বৈঠক শেষ করে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। বহু প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমি আশা করছি, এই যুদ্ধ থামাতে উভয় পক্ষই আন্তরিকভাবে কথা বলছে।’

কূটাভাস হলো এই, ১৮ বছর আগে যে তালেবানকে আমেরিকা কাবুল থেকে উৎখাত করেছিল, নিজেদের সেনা ফিরিয়ে নিতে সেই তালেবানের সঙ্গে এখন তাকে আলোচনা করতে হচ্ছে। এরপরও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিধর আমেরিকা দাবি করছে, আফগান যুদ্ধে তাদের পরাজয় হয়নি। যে লোকগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে আমেরিকা একসময় সামরিক অভিযান চালিয়েছে এবং যাঁদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়েছে, তাঁদের সঙ্গেই এখন দেশটির কর্মকর্তারা এক টেবিলে বসেছেন। দোহা বৈঠকে যোগ দেওয়া তালেবান প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রায় সবাই দীর্ঘ সময় লড়াই করেছেন এবং জেল খেটেছেন। কিন্তু মোল্লা বারাদার তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। তালেবান পুনর্গঠনে তাঁর সামরিক নৈপুণ্যের কারণে অনুসারীরা তাঁকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখেন।

তরুণ বয়সে বারাদার সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদে’ অংশ নেন এবং এই সময়েই তিনি মোল্লা ওমরের সংস্পর্শে আসেন। তিনি কারাগারে থাকার পর তাঁর অনুসারীরা কিছুটা দমে গেলেও এখন তাঁরা চাঙা হয়ে উঠেছেন। গত বছর তিনি ছাড়া পাওয়ার পর তালেবান আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি এলাকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছে।

দোহা আলোচনায় বারাদার যেভাবে অংশ নিয়েছেন, তাতে তাঁর নামের সঙ্গে সন্ত্রাসী তকমা এঁটে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শুধু বারাদারকে নয়, পুরো তালেবান শক্তিকে একধরনের বৈধতার স্বীকৃতি দিয়েছে। এর জের বহুদিন থাকবে।

ডন পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত


জাহিদ হুসাইন পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক