শিক্ষকেরা যখন ক্ষমতার সেবায় ছাত্রবিরোধী হন

ডিম নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ডাকসু ভিপি নুরুলও। ছবি: সংগৃহীত
ডিম নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ডাকসু ভিপি নুরুলও। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসুখ অনেক দিন ধরেই। এখন এর হাঁচি–কাশি প্রতিদিন জোরেশারেই শোনা যায়। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত ডাকসু এই অসুখ সারাবে এই আশা নিশ্চয়ই কেউই করেননি বরং অস্বস্তি এবং শিক্ষকদের নৈতিক পরাজয়ের এই নির্বাচনের রেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে টানতে হবে নানাভাবে, এই আশঙ্কাই করেছেন অনেকে। নানা ধরনের অভিযোগ এবং অনিয়মে মোড়া ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নানা বাহাসকে উপেক্ষা করে শপথ নিয়েছেন ডাকসুর নির্বাচিত নেতারা। কিন্তু বোধের আড়মোড়া ভেঙে বিশ্লেষণে গেলে দেখা যাবে যে ডাকসু নির্বাচন আসলে ক্ষমতাসীন সংগঠনের নিপীড়নের মনস্কতা জারি এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে একধরনের ‘বৈধতা’ দিয়েছে, যার প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের ঘটে যাওয়া নিপীড়নের ঘটনায়। ফেসবুকের কল্যাণে আমার চোখের সামনে বারবার রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী ফরিদ হাসান। আরেক শিক্ষার্থী ও ছাত্র ফেডারেশন নেত্রী বেনজীরের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখটি কোনোভাবেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের দাবিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্পনার পরিবেশের সঙ্গে মেলে না। ডিম নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ডাকসু ভিপি নুরুলও। আর এরই সঙ্গে যখন অন্যান্য শিক্ষার্থীর গায়ে, চুলে লেপ্টে থাকা ডিমের অংশ দেখি তখন মনে হয় না, সত্যি মনে হয় না এটি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। আর যদি এই চিত্রকে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখি, তাহলে ভাবতে হবে নিপীড়ন আর ডিম ছোড়াই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি।

এসএম হলের নির্বাচিত হল সংসদ এবং ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া ফরিদ হাসানের কপালের ডান পাশ ও ডান কানে মোট ৩২টি সেলাই পড়েছে৷ এই ফরিদও কিছুদিন আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগই করতেন। ঢাকসু নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। সেই সময় থেকেই হল ছাত্রলীগ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর টানাপোড়েন শুরু হয়। বর্তমানে তিনি ৩২টি সেলাইকে সম্বল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি আছেন৷ সেই হল সংসদের জিএস ছাত্রলীগের জুলিয়াস সিজার জানিয়েছেন যে ফরিদের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ থাকায় তাঁকে হল ছাড়তে বলা হয়েছে৷ এখন কথা হলো, যেখানে একমাত্র হল প্রশাসনই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সিট দেওয়া এবং বাতিল করার ক্ষমতা রাখে, সেখানে কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের নেতা কাউকে হল ছাড়তে নির্দেশ দিতে পারেন? আর কেউ যদি মাদক সেবনও করেন, সেটি দেখা এবং সেটির বিচার করা কোনো শিক্ষার্থীর কাজ নয়, সেটির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন। কিন্তু সেগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হলগুলোতে এই ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের বিরুদ্ধে হল প্রশাসন কি কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে? মাননীয় হল প্রভোস্ট, বিনীতভাবেই একজন সহকর্মী হিসেবেই জানতে চাই, কেন আপনার হলের একজন শিক্ষার্থীর শরীরে ৩২টি সেলাই পড়ল, শিক্ষক হিসেবে সেই প্রশ্নটিই তো আগে আসা দরকার ছিল, তাই না?

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে ফরিদের ওপর হামলার বিচার চেয়ে মঙ্গলবার এসএম হলের প্রাধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক, সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, শামসুন নাহার হল সংসদের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ, ডাকসুতে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তি খান ও ছাত্র ফেডারেশন থেকে ডাকসুর জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীরসহ বেশ কয়েকজন৷ তাঁদের মধ্যে বেনজীর আঘাত পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। প্রক্টর কার্যালয় থেকে তাঁদের এসএম হলের প্রাধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিতে বলা হয়েছিল৷ সেই মোতাবেক স্মারকলিপি দেওয়ার জন্য এসএম হলের ভেতর ঢুকলে নুরুল ও আখতারের সঙ্গে থাকা অন্যদের ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের প্রাধ্যক্ষের কক্ষে অবরুদ্ধ করে ফেলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা৷ সেই সময় ওই কক্ষে ঢুকতে চাইলে সাংবাদিকদেরও লাঞ্ছিত করা হয়৷ আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা তাঁদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন, নারী শিক্ষার্থীরা শারীরিক এবং ভাষাগত নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন। শুধু শারীরিক আক্রমণ করেই ক্রোধ কমেনি তাঁদের, তাঁরা স্মারকলিপি প্রদানকারীদের ডিম ছুড়েছেন। আর হল প্রশাসক বলছেন, ‘ছাত্রলীগ নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীরা ডিম ছুড়েছে’। আহা, যেন ডিম দিয়েই হয়েছিল সেদিনের ভলিবল খেলা! হল প্রশাসকই ছিলেন রেফারি!

ডিমের তদারকিতেও কি ছিলেন হল প্রভোস্ট? তা না হলেন তিনি কীভাবে জানলেন ছাত্রলীগ নয়, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরাই’ ডিম মেরেছেন? আর যদি সেটি করেও থাকেন, তাহলে শিক্ষক হিসেবে কেন তিনি বললেন না, কেন তাঁর একজন শিক্ষার্থী আরেকজন শিক্ষার্থীকে মারবেন, গায়ে হাত দেবেন? কেন ডিম মেরে একে অপরেকে অসম্মান করার চেষ্টা করবেন?

যতটুকু বুঝি, ঢাকসু নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সেটি বজায় রাখার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়া। সেখানে একজন শিক্ষার্থীর নিরাপদে হলে থাকার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকেন হল প্রশাসন। এই হল প্রশাসকেরা শুধুই প্রশাসক নন। তাঁরা শিক্ষক হল প্রশাসক। তাই তাঁদের দায় এবং দায়িত্ব দুটোই বেশি। কিন্তু হল প্রশাসকেরা যদি সেটি না করে ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতা–কর্মীদের নির্যাতন-নিপীড়নকে আশকারা দেন, ইনিয়ে–বিনিয়ে কিংবা প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার জায়গাটুকুও থাকে না। শিক্ষকেরা একেকজন এখন ফাউস্ট হতে চান। তাই তাঁরা ক্ষমতাবদ্ধ হতে চান। ক্ষমতাসীন সংগঠনের ছাত্রনেতাদের মেজাজ–মর্জির দেখভাল করেন, আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নৈতিক দূরত্ব তৈরি করেন। এভাবেই পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাপনাই হয়ে উঠছে ‘ডিমময়’।

কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? এগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা প্রশাসনের ভাষ্যে, ‘হলের অভ্যন্তরীণ’ বিষয়? না, একেবারেই না। বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাত দেখিয়ে, মিছিলে না যেতে চাইলে কিংবা বিরোধী দল কিংবা অন্য সংগঠনের সদস্যদের এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের হলগুলোতে সরকার–দলীয় সংগঠনের নেতা–কর্মীদের হাতে নানাভাবে হুমকি-ধামকি, গণরুমে নিপীড়ন, ‘সহনীয়’ চড়-থাপ্পড়সহ চোখ হারানোর মতো নিপীড়নের ক্ষতের বহু জ্বলে থাকা উদাহরণ তো রয়েছেই। এগুলোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর বাস্তবতা।

এমন বাস্তবতা এক দিনে তৈরি হয়নি, যেমন শিক্ষকেরাও এক দিনেই পরাজিত সৈনিক হননি। আস্তে আস্তে তাঁরা নিজেদের এই পথের সৈনিক করেছেন, আর এই বাস্তবতা তৈরিতে খানাখন্দ দিয়েছেন। তাই তো চিত্রগুলো আমাদের কাছে এই রকম সিনেমার মতো হাজির হয়, দেখে আমাদের হুদয় আছাড় মারা বিষণ্নতা তৈরি হয়, শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ শিক্ষকদের কেমন যেন দূরের মোড়ল ভাবা শুরু করেছি, যাঁরা নিত্যক্ষমতার জামা খোঁজেন...কিন্তু শিক্ষার্থীর শরীরের ৩২টি সেলাইয়ের ফোঁড়ের জন্য কখনো প্রশ্ন তোলেন না, একবারের জন্যও বলেন না—এ আমার বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না... এ দায় আমার, আমাদের।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]