শিশুদের মনে আলো জ্বালিয়েছেন দাদাভাই

রোকনুজ্জামান খান
রোকনুজ্জামান খান

এখনকার শিশুরা জানে না, শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান লাখ লাখ শিশুর মনে আলো জ্বালিয়েছেন। তিনি ‘দাদাভাই’ নামেই বেশি পরিচিত। আজ তাঁর ৯৪তম জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলায় সাহিত্য-সংস্কৃতিসমৃদ্ধ একটি পরিবারে। তিনি একাধারে ছিলেন শিশু-সংগঠক ও শিশুসাহিত্য সম্পাদক। দৈনিক ইত্তেফাক-এর ছোটদের পাতা ‘কচি-কাঁচার আসর’ ঘিরে ১৯৫৬ সালে সুফিয়া কামাল, আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন এবং রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের মতো প্রগতিশীল ধ্যানধারণার অধিকারীরা জন্ম দেন ‘কচি-কাঁচার মেলা’।

প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে ‘কচি-কাঁচার আসর’, শিশু ও কিশোর সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা, ‘কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা’ পরিচালনার মাধ্যমে আলোর বাতিরূপে তিনি দেশজুড়ে শিশু-কিশোরদের প্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৫০–এর দশক থেকে ১৯৯৯ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছোট-বড় সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ওই সময়ের শিশু-কিশোরদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বনিয়াদ তৈরি করে দেওয়া ও তার বিকাশে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সাংস্কৃতিক পরিচর্যার মধ্য দিয়ে দাদাভাই শিশুদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার কাজ করে গেছেন। তাঁদের জীবনবোধকে সুন্দর ও সভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার বীজ বপন করে দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। তাঁর অনুসারী ওই সময়ের শিশু-কিশোরেরা বর্তমানে আমাদের শিল্প ও সাহিত্যজগৎকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

দাদাভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে মনে পড়ে গেল আমাদের পাড়া, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মসজিদ কলোনির দুটি সংগঠনের নামও—ছেলেদের নবাঙ্কুর কচি-কাঁচার মেলা এবং মেয়েদের ভোরের পাখি কচি-কাঁচার মেলার কথা। ১৯৭০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় মহা উল্লাসে যোগ দিয়েছিলাম নবাঙ্কুর শাখায়। আলাদা শাখা-সংগঠন হলেও দাদাভাইয়ের নামে এর কার্যক্রম চলত প্রায় একই সঙ্গে, প্রতিযোগিতাও চলত। এখনো ‘কচি-কাঁচা’ শব্দটা আলো জ্বালে মনে। কেউ কচি-কাঁচার সদস্য/সদস্যা, সাথিভাই, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, পরিচালক এসব পরিচয় পেলে তাঁকে আপন মনে হয়। মনে হয় ও/উনি তো আমার আপন সত্তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ এক অসাধারণ উপলব্ধি।

তরুণ চিকিৎসক হিসেবে কক্সবাজার-টেকনাফ-কুতুবদিয়ায় সরকারি চাকরির সুযোগ ঘটে আমার। আশির দশকের শেষের দিকে উপদেষ্টা হিসেবে প্রবাল কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে যুক্ত হই। পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। এ সময় প্রবাল কচি-কাঁচার মেলার জমজমাট আসর ও কার্যক্রম দাদাভাই কর্তৃক বিপুলভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। ইত্তেফাক পত্রিকার কচি-কাঁচার আসরে প্রায়ই ছাপা হতো এই মেলার শিশু-কিশোরদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও নানা ধরনের সেবামূলক কাজের খবর।

বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য তিনি কুমিল্লা থেকে গোলাম মোস্তাফা ভাইকে (কুমিল্লা মেলার সংগঠক) পাঠিয়েছিলেন টেকনাফ। আমাদের প্রবাল মেলার সব পরিষদের সদস্যকে নিয়ে আমরা ত্রাণ বিতরণ করি। দাদাভাইয়ের কাজ কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল দেশজুড়ে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত শিশুশিল্পী-সাহিত্যিকদের দল নিয়ে দাদাভাই নিজেও বেড়াতে গেছেন টেকনাফ-কক্সবাজার। তুমুল উদ্দীপনায় পুরো দলকে আমরা সংবর্ধনা দিই। সে এক সোনালি ঐতিহ্য প্রবাল কচি-কাঁচার মেলার।

এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে কখন যে দাদাভাইয়ের অতি প্রিয় হয়ে উঠেছিলাম, জানি না। তিনি শেষ কথা আমাকে বলেছিলেন ১৯৯৯ সালে তাঁর মৃত্যুর সপ্তাহখানেক আগে, ‘মোহিত, তোমার তিনটা বিল জমা হয়েছে, নিয়ে যেও।’ যাওয়া হয়নি, দেখা হয়নি আর। তবে শেষবারের মতো দেখেছি আমার প্রিয় দাদাভাইকে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কফিনের ভেতরে।

বাংলা একাডেমির একুশে গ্রন্থমেলায় যখন ঘোরাঘুরি করি, তখন উচ্চারিত হতে শুনি দাদাভাইয়ের নাম, আনন্দে বুক ফুলে ওঠে। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান একসময় দাদাভাইয়ের সহকারী সম্পাদক ছিলেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশে পিছপা হননি। অগ্রজের কীর্তিকে ধরে রেখেছেন আমাদের কালের পাতায়।

বাংলা একাডেমিতে দাদাভাইয়ের নামে পুরস্কার দেওয়া হয় প্রতিবছর। কৃতজ্ঞ আমরা সাবেক এ মহাপরিচালকের কাছেও।

দাদাভাই, আমাদের প্রজন্মের কেউ কি ভুলে যেতে পারে আপনাকে?

না, কখনোই না।

মোহিত কামাল: কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক, শব্দঘর