সি চিন পিংয়ের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

সি চিন পিং
সি চিন পিং

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রবল তৎপরতায় তাঁর কাজ চালাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। চাঁদের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটায় তিনি রকেট পাঠিয়েছেন, দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত জলসীমায় কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছেন এবং অতিসম্প্রতি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে ইতালিকে তার ইউরোপীয় অংশীদারদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্ত হতে রাজি করাতে সমর্থ হয়েছেন। বলা হচ্ছে, চীন যখন সাঁই সাঁই করে এগোচ্ছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবাস্তব মনোভঙ্গির কারণে আমেরিকার অন্তঃস্থ প্রভাব ও ক্ষমতা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে চলেছে।

গত চার দশকে চীনের আর্থিক উন্নয়নের চিত্র উত্তরোত্তর উজ্জ্বল হয়েছে। বর্তমানে ১০০-এর বেশি দেশের প্রধান বাণিজ্যিক পার্টনার হচ্ছে চীন। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের পার্টনারের সংখ্যা তার অর্ধেক। প্রায় সব গবেষকই মনে করেন, আসন্ন দশকে চীনের অর্থনীতি আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাবে। হয়তো তাঁদের কথা ঠিক। কিন্তু এত কিছুর পরও সি চিন পিংয়ের কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে।

চীনের ভবিষ্যৎকে কে সুরক্ষা দিতে পারবে, তা আসলে কেউই বলতে পারে না। চীনের অর্থনীতি একসময় দুমড়েমুচড়ে যাবে বলে বহুবার বহু গবেষক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং শেষমেশ তাঁদের সে কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তবে প্রথাগত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যেভাবে চীনের শক্তিমত্তার বিবরণ দিয়ে থাকে, আমি সেগুলোকে সর্বান্তকরণে মানতে পারি না। আমার মনে হয়, চীনের শক্তি নিয়ে অতিরঞ্জনও আছে। চীন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কমপক্ষে কয়েকটি বড় দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা চীনকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

প্রথমত, চীনের সামনে একটি প্রতিকূল জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রোফাইল রয়েছে। দেশটির শ্রমশক্তির চরম উৎকর্ষকাল অতিক্রান্ত হয়েছে ২০১৫ সালে। ওই বছরই চীনারা যৌবনদীপ্ত শ্রমশক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পেরেছে। এখন সেই শক্তি বার্ধক্যের দিকে যেতে শুরু করেছে। দিন যত যাবে, তাদের বয়স তত বাড়বে এবং স্বাস্থ্য খাতে খরচ বাড়তে থাকবে। এটি অর্থনীতির জন্য একটি বোঝা হয়ে দেখা দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, চীনকে তার আর্থিক মডেল বদলে ফেলতে হবে। ১৯৭৮ সালে দেং জিয়াওপিং চীনের মাওপন্থী স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে রপ্তানিভিত্তিক অর্থনীতি গ্রহণ করেছিলেন। একইভাবে বর্তমান বাণিজ্যনীতিও চীনকে বদলে ফেলতে হবে। দেশটির আমদানি-রপ্তানি আইনে এমন অনেক ধারা-উপধারা আছে, যা পশ্চিমা দেশগুলোকে চীনে বিনিয়োগ করার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এই সব নীতি ও বিধি সংশোধন করে চীনকে সবার বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে।

কূটাভাস হলো এই, বহুদিন ধরেই চীন নিজেই নিজের সাফল্যের ভিকটিম হয়ে পড়েছে। ১৯৪৯ সালে মাও সে–তুং চীনে লেনিনের অর্থনৈতিক মডেল আরোপ করেছিলেন। চীনের তৎকালীন প্রভুত্ববাদী ঐতিহ্যের সঙ্গে এই মডেল বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন চীনকে এবং চীনের রাজনৈতিক চাহিদার ধরনকে খুব কম সময়ের মধ্যে পাল্টে ফেলে। চীন হয়ে ওঠে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমাজ। তবে ক্ষমতাসীন অভিজাত মহল সেই সাবেক রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার মধ্যেই আটকা পড়ে ছিল। সি চিন পিং এই অভিজাতদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পথে এগিয়েছেন। এ জন্য পদে পদে তাঁকে বাধাও পেতে হচ্ছে।

দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান তিনি শুরু করেছেন, তাঁদের দলের বহু প্রভাবশালী নেতা ফেঁসেছেন। ফলে তাঁরা সি চিন পিংকে অসহযোগিতা করছেন। একজন চীনা অর্থনীতিবিদ আমাকে বলেছেন, সি চিন পিংয়ের এই উদ্যোগের দাম দিতে হচ্ছে প্রতিবছর ১ শতাংশ জিডিপি কমার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছেন, সরকারিভাবে চীনের প্রবৃদ্ধির যে অঙ্ক দেখানো হচ্ছে, আদতে তা অর্ধেকের কম।

সর্বশেষ কথা হলো, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করতে চীন যে পরিমাণ অর্থ ঢেলেছে, এর প্রতিফল সে অনুযায়ী মেলেনি। গত এক দশকে দেশটি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এই লক্ষ্যে খরচ করেছে। কিন্তু মানবাধিকার, জাতিগত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আচরণসহ নানা ইস্যুতে দেশটি কাঙ্ক্ষিত শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেনি। সব মিলিয়ে বিশাল চ্যালেঞ্জ সি চিন পিংয়ের সামনে পাহাড় হয়ে আছে। সেই পাহাড় ডিঙানো তাঁর পক্ষে খুব সহজ হবে না।

 ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ এস নায়ি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক