মাদ্রাসার মেয়েটির অন্তিম জিদ শুনেও আমরা নীরব?

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধ ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী। ফাইল ছবি
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধ ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী। ফাইল ছবি

মেয়েটির এক লড়াইয়ের পাটাতন থেকে যে ঝাঁপ দিয়েছে আরেক লড়াইয়ের ময়দানে। তার শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। এর আগে আসলে আমরা নিজেদের বিবেক, মনোযোগ, আত্মা ও হৃদয় পুড়িয়েছি ১০০ শতাংশই। যৌন নিপীড়কদের কাছে মেয়েটির অপরাধ, মেয়েটির পরিবার মামলা করেছিল তারই যৌন নিপীড়ক শিক্ষক সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে। 

আমি নামটি ইচ্ছাকৃতভাবেই লিখলাম। কারণ, বেশির ভাগ মিডিয়াই যৌন নিপীড়ক এবং মেয়েটিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গায়ে আগুন লাগানোর পরিকল্পনার হোতার পরিচয় দিয়েছে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে। খুব কম মিডিয়াই যৌন নিপীড়ক এবং হত্যার পরিকল্পনাকারীর নাম দিয়েছে। মেয়েটি সেই মাদ্রাসাতেই পড়ত। নিপীড়ক তার শিক্ষক এবং মেয়েটি তাঁকে ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করত। জনমতে ধারণা আছে যে মাদ্রাসায় কোরআন পড়ানো হয়, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ছেলেমেয়েদের আদব-কায়দা শেখানো হয় ও ‘নৈতিক’ শিক্ষা দেওয়া হয়। ধর্মের কথা বলা হয়। অনেক মা-বাবা হয়তো তাঁর কন্যাসন্তা‌নের নিরাপ‌ত্তার কথা চিন্তা ক‌রে মাদ্রাসায় পড়ান। কিন্তু বারবারই দেখা গেছে, অনেক মাদ্রাসায়ই নারীরা নিরাপদ নয়। আরও সামনে এসেছে যে হিজাব, বোরকা কিংবা কোনো পোশাকই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, নারীর প্রতি যৌন হয়রানি রুখতে পারে না। তবে মাদ্রাসায় নারীর প্রতি যৌন হয়রানির পাশাপাশি পুরুষ শিক্ষার্থীর ওপর যৌন নিপীড়নের খবরও মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এবং এ কথা বলাবাহুল্য যে দরদি শিক্ষকের সংখ্যাই সেখানে নিশ্চয়ই বেশি।

মাদ্রাসার এই ছাত্রীটির ওপর কয়েক দফা নিপীড়ন–অভিজ্ঞতা তাকে জীবনের শেষ সীমানায় নিয়ে গেছে। প্রথমটি শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়ন, সেটির প্রতিকার চেয়ে পরিবার থেকে মামলা করা হলে সেই মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি এবং চাপ। সেই চাপের একটি ধাপ ছিল তার গায়ে আগুন দিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা। এবং এখানেও ব্যবহার করা হয়েছে মাদ্রাসারই ছাত্রীদের। এক অভিনব কায়দায় মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রের ছাদে এবং সেখানে চারজন মেয়ে মেয়েটিকে ‘হুজুরের’ বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়। মেয়েটি রাজি হয়নি। তাই তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এখনো অব্যাহত আছে হুমকিমূলক তৎপরতা। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং হাসপাতালে মেয়েটির অভিভাবকদের পাশে থাকা একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে যতটুকু জানা গেছে, তা হলো হাসপাতালে একটা পেপার এসেছে থানা থেকে, যেখানে লেখা মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা করছিল এবং সেটি স্বীকার করে ওর অভিভাবকদের স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছে সেখানে।

তবে এ ঘটনায় আমাদের দেশের প্রতিবাদের রাজনীতি চরিত্র যদি আমরা বিশ্লেষণে যাই তাহলে দেখব যে এই বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি প্রতিবাদ, মানববন্ধন এবং দ্রুততম সময়ে যৌন নিপীড়কের শাস্তি চাওয়ার বড়সড় আওয়াজ ওঠেনি। দ্রুততম শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি এই কারণেই যে এই যৌন নিপীড়ক সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে আরও কয়েকবার মামলা হয়েছে এবং তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সব কটিতেই তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। এবারের চেষ্টাও হয়তো সেই রকমই। তাই সবাই যখন মেয়েটিকে বাঁচানো নিয়েই মনোযোগী, নিপীড়ক মনোযোগী মামলা খারিজের জন্য। মামলার বিষয়ে আমাদের আপাত অমনোযোগিতাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন নিপীড়ক। তাই এই বিষয়ে আমাদের অতি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু আমরা যে গতিতে মেয়েটির শ্বাস ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করছি, সেই একই গতিতে সেই নিপীড়কের দ্রুত বিচারের দাবি তুলছি না। এর কারণ হলো মেয়েটি মাদ্রাসায় পড়ত। মাদ্রাসায় পড়া এক শিক্ষার্থীর জন্য আমাদের মধ্যবিত্তীয় অতি প্রতিবাদী ঘরানা ততটা সাড়া দেয়নি। এখন পর্যন্ত দু-একটি নারী সংগঠনই এর প্রতিবাদ করেছে মাত্র। কিন্তু বড় মাপের প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি, যে রকম হয়ে ওঠে ভিকারুননিসা কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। আর মাদ্রাসার ছাত্রীর বিষয়ে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে হয়তো বাম-ডান বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘারানার নানা ধরনের টানাপোড়েন আছে। আছে নানা ধরনের ‘তকমা’ দেওয়ার ভয়। সেই সঙ্গে আছে ব্যক্তিক উৎপতনের সম্ভাবনা। এত বিষয় যেখানে রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের কর্মী এবং মোটাদাগের অ্যাকটিভিস্টদের গলা চেপে ধরে আছে, সেখানে মাদ্রাসার ছাত্রীকে যৌন হয়রানি এবং হত্যার চেষ্টা করলেও দ্রুত ন্যায়বিচারের দাবিতে তাদের জোরালো স্লোগান আর কানে বাজে না। কারণ, মাদ্রাসার প্রতি আমাদের মতাদর্শিক সমর্থন-অসমর্থন দিয়ে আমরা মেয়েটির যৌন নিপীড়ন, ঝলসে যাওয়া শরীর এবং জীবনের অভিজ্ঞতা মাপার চেষ্টা করি, যার ফলে বিষয়টিকে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই।

আমরা চোখে, মুখে, বোধে পাশ কাটাই কিন্তু রাজনৈতিক, একাডেমিক এবং মতাদর্শিকভাবে এগুলোর সঙ্গে সামাজিক এবং রাজনৈতিক দেনদরবারের চেষ্টা করি না। আমরা ভাবি না আমাদের এই দোনোমনা এবং চেপে থাকা অস্বস্তিই যৌন নিপীড়নের চাষাবাদের প্রসার বাড়াচ্ছে। আমাদের এই সামাজিক এবং রাজনৈতিক খামতি এই বিষয়ে সরকারের মতাদর্শিক অসারতাকেই রসদ দেয় মাত্র।

পত্রিকা মারফত জানা যে শরীর আগুনে ঝলসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থানই নয়, লাইফ সা‌পোর্টে নেওয়ার আগে ব্যান্ডেজে মোড়া শরীরটির মধ্যে বেঁচে থাকা প্রাণটিকে সম্বল করে শক্তভাবেই দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী তার মা ও ভাইকে শেষ কথা হিসেবে বলে‌ছে যে তার যা হয় হোক, তার এ অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তা‌দের যেন বিচার হয়। চরম ক্ষণেও প্রতিকারের জিদ মেয়েটি ছাড়েনি। আর আমরা হাল ছেড়ে দেব? আমরাও এর দ্রুত বিচার চাই। সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিপীড়নের শিকার কিংবা মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছে সরকার, কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। কারণ, মূল কারণের দিকে দৃষ্টি নেই। তাই এ ধরনের ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি যদি অল্প সময়ের মধ্যে হয়, তাহলে হয়তো এই ধরনের অপরাধ কিছুটা কমত। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সহযোগিতা নিশ্চয়ই কাউকে বাঁচানো এবং তার প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপনের একটি বড় জায়গা, কিন্তু তাতে অপরাধ আর অপরাধী দুটোই থাকে নিশ্চিন্তে। কেননা এর মধ্য দিয়ে নিপীড়নের শিকার ব্যক্তির প্রতি সদয় অনুভূতির জোগান হয় বটে, কিন্তু অপরাধ নির্মূলে বাড়তি কোনো চেতনা বা পদক্ষেপ তৈরি হয় না।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]