নির্যাতিত নারীর জবানবন্দি

সুপ্রিম কোর্ট নারী হাকিম দিয়ে নারী নির্যাতন মামলার ভিকটিমের জবানবন্দি রেকর্ড করার ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। শীর্ষ নারী সংগঠনগুলোও সংগত কারণে স্বাগত জানিয়েছে। তবে এখন বিষয়টিকে অধিকতর কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে।

ফেনীর সোনাগাজীর হতভাগ্য মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান তাঁর প্রাথমিক জবানবন্দি কিন্তু স্থানীয় থানার ওসির কাছেই দিয়েছিলেন। এটা মনে রাখতে হবে যে বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জে নির্যাতিত নারীর প্রথম ভরসাস্থল আদালত নয়, পুলিশ প্রশাসন। মামলা করার পরই কেবল ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারার আওতায় ভিকটিমের জবানবন্দির বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হবে। সোনাগাজীর ওসির কাছে দেওয়া জবানবন্দির একটি ভিডিও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এতে দেখা যায়, নুসরাত অভিযুক্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের বিবরণ দিতে কতটা সংকোচ করছিলেন। অন্যদিকে এটাও পরিষ্কার হয়েছে যে পুরুষ কণ্ঠগুলো তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে কতটা অসংবেদনশীল ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছেই সারা দেশে অহরহ ভিকটিম নারীকে একধরনের জবানবন্দি দিতে হয়। এটা অনানুষ্ঠানিক হলেও এর গুরুত্ব কম নয়।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যে চেতনা থেকে নারী হাকিম দিয়ে জবানবন্দি নেওয়ার বিধান করেছেন, সেটাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন অনুসরণ করতে পারে। একসময় বিচার বিভাগে নারী বিচারকের সংখ্যা কম ছিল। এখন লোকবলের সংকট নেই। অধস্তন আদালতের প্রায় ১ হাজার ৭০০ বিচারকের মধ্যে প্রায় ৫০০ নারী বিচারক। তদুপরি সুপ্রিম কোর্টের পরিপত্রে বলা হয়েছে, যেখানে নারী হাকিম মিলবে না, সেখানে উপযুক্ত কোনো হাকিম জবানবন্দি নেবেন। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মর্মে একটি পরিপত্র জারি করতে পারে যে নারী ভিকটিমের নির্যাতিত হওয়ার বিবরণ পারতপক্ষে পুলিশের কোনো পুরুষ কর্মকর্তা গ্রহণ করবেন না।

বাংলাদেশের থানাগুলোতে এখন নারী কর্মকর্তা অপ্রতুল থাকলেও নারী কনস্টেবলের সংখ্যা কম নয়। পুলিশের লোকবল বিভাগ নীতি নির্ধারণ করতে পারে যেকোনো কর্মস্থলে নারী কনস্টেবলের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার নিচে আনা যাবে না। এটা সহজে নিশ্চিত করা সম্ভব। এর ফলে থানায় গিয়ে ভিকটিম নারী তাঁর দুঃখ-কষ্টের কথা অকপটে পুলিশের নারী সদস্যের কাছেই বলতে পারবেন। আমরা মনে করি, বিচার বিভাগের চেয়ে দেশের থানাগুলোকে ভিকটিম নারীর জন্য অধিকতর সংবেদনশীল ও নিরাপদ করার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নেয়, তবে আমরা নিকট ভবিষ্যতে কোনো একটি উপযুক্ত বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ দেখার জন্য অপেক্ষা করব। সাম্প্রতিক একাধিক দুঃখজনক ঘটনা সাক্ষ্য দিচ্ছে, ভিকটিম নারীর প্রথম নালিশের ক্ষেত্র হিসেবে থানা অনেক ক্ষেত্রেই অনিরাপদ। তাই থানাগুলোকেই দায়িত্বশীল ও নিরাপদ করাটা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

নারীর জবানবন্দি রেকর্ড করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট যে পরিপত্র দিয়েছেন, সেটা সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগ সংস্কার কমিটির সিদ্ধান্তে এসেছে। প্রধান বিচারপতির আদেশক্রমে রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত ১৫ এপ্রিল জারি করা পরিপত্রে আমরা দেখি, ভিকটিমের জবানবন্দি যাতে নারী হাকিম দিয়ে রেকর্ড করানো হয়, সেটা বিচারকদের প্রতি একটি ‘বিশেষ অনুরোধ’। এর অর্থ, বিদ্যমান আইনে এ বিষয়ে পুরুষ হাকিম বা বিচারকের দ্বারা রেকর্ড করানোর বিষয়টি আইন হিসেবেই টিকে থাকছে। পরিপত্র আইনের বিকল্প নয়। অপরাধের তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে এ জবানবন্দি যেহেতু ‘অত্যন্ত গুরুত্ব’ বহন করে, তাই আমরা অভিজ্ঞতার আলোকে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়কে ভবিষ্যতে আইনে সংশোধনী এনে একে স্থায়ী রূপ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে অনুরোধ রাখব।