সচেতন হতে চাই সচেতনতা

কয়েক দিন আগের কথা। একটি বহুতল ভবনের লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লিফট আসতে সময় লাগছিল; তাই তাকাচ্ছিলাম আশপাশে। দেখলাম, লিফটের পাশে সদ্য লাগানো হয়েছে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে করণীয়–সংক্রান্ত একটি পোস্টার। বুঝলাম, পোস্টারটি মূলত তৈরি হয়েছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চুড়িহাট্টা, এফ আর টাওয়ারসহ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে। এই পোস্টারের ঠিক পাশেই রয়েছে আরেকটি পোস্টার, যেখানে বলা হয়েছে ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে। পোস্টারটি দেখে বেশ পরিষ্কারভাবেই বোঝা গেল, সেটি বেশ পুরোনো। ভাবছিলাম, ভূমিকম্পের পোস্টারটি ফিকে হয়ে এলেও ভূমিকম্পের ঝুঁকি হারিয়ে যাবে কি?

বিভিন্ন বড় বড় দুর্যোগের বাস্তবতা আর ভয়াবহতা সময়ের প্রভাবে আমাদের মন থেকে হারিয়ে যায় বারবার। মনে পড়ে, ২০১৫-১৬ সালে কয়েক দফা ভূমিকম্প হওয়ার পর অনেকেই নড়েচড়ে বসেছিলেন। আলাপ–আলোচনা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ে নানা অব্যবস্থাপনা আর অরাজকতা নিয়ে। কিন্তু সে আর কয় দিন! পরে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা হওয়ার পর আমাদের সব মনোযোগ সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। শুরু হয় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চিরুনি অভিযান। গলির মুদিদোকান, ফুটপাতের সস্তা গয়নার দোকান, ওষুধের ছোট ডিসপেনসারিতেও লক্ষ করেছি সিসি ক্যামেরার উপস্থিতি। ছোট–বড় বিপণিবিতানে ভ্যানিটি ব্যাগ কিংবা দেহ তল্লাশির মুখোমুখি হয়েছি। স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন করে শুরু হয়েছিল মূল্যবোধ শিক্ষার সেশন, অভিভাবক সভা ইত্যাদি। কিন্তু আজ তিন বছরের মাথায় অধিকাংশ সিসি ক্যামেরাই খেলনা ক্যামেরায় রূপ নিয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনী ফিরে গিয়েছে তাদের পুরোনো ভূমিকায়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এখন মূল্যবোধ শিক্ষার অতিরিক্ত সেশনটিতে যোগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত।

দেশে সাম্প্রতিক সময়ের দুর্যোগের নাম অগ্নিকাণ্ড। মনে পড়ে, পুরান ঢাকার নিমতলীতে ২০১০ সালের জুন মাসে ভয়াবহ আগুনে ঝরে যায় ১২৪টি প্রাণ। তদন্তে বেরিয়ে আসে, রাসায়নিকের গুদামে রক্ষিত দাহ্য পদার্থের কারণেই অগ্নিকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর গঠিত হয় টাস্কফোর্স, করা হয় নানা অঙ্গীকার, নেওয়া হয় নানা পরিকল্পনা। রাজধানী থেকে রাসায়নিক গুদাম-কারখানা সরিয়ে নিতে গঠন করা হয় দুটি কমিটি। সেই কমিটি কেরানীগঞ্জ আর নারায়ণগঞ্জে জায়গা ঠিক করার সুপারিশসহ উচ্চমাত্রার বিপজ্জনক পাঁচ শতাধিক রাসায়নিকের তালিকা করে প্রতিবেদন দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সম্প্রতি চুড়িহাট্টায় সংঘটিত হওয়া অগ্নিকাণ্ড আর লাশের মিছিল স্পষ্টতই জানান দিয়েছে, বাস্তবায়িত হয়নি কোনো কিছুই। এরপর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বহুতল ভবনসমূহের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনাসহ সামগ্রিক অবকাঠামোকে। কিন্তু কদিন পর থেমে গেছে সব। নোয়াখালীর সোনাগাজীর নুসরাতের মৃত্যু যেন নতুন করে সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে। অথচ বিষয়টি কিন্তু নতুন কিছু নয়।

আমরা কেন জানি বারবার ভুলে যাই আমাদের সমস্যার মূলে থাকা বিষয়গুলো! সব সমস্যাকে বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের বড় অভাব। সরকার, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্বে অবহেলা, নৈরাজ্য আর উদাসীনতার কথা বলতে বলতে আমরা আজ ক্লান্ত। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়েও আমরা বড্ড বেশি অসচেতন। আমরা কজন নিয়মিত পরীক্ষা করি বাসাবাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র কিংবা গ্যাসের সিলিন্ডার? কজন বাসার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি! ট্রাফিক আইন অমান্য করে কিংবা পদচারী–সেতু এড়িয়ে রোজ আমরা রাস্তা পার হই, সামান্য সুযোগ পেলেই রং সাইডে গাড়ি চালাই।

ভূমিকম্পের তীব্র ঝুঁকিতে বসবাস করেও আমরা কজন বিল্ডিং কোড মেনে নতুন বাসাবাড়ি নির্মাণ করছি? যে বাসাবাড়িগুলোতে আমরা বসবাস করছি সেগুলো কতটুকু ঝুঁকিমুক্ত, তা যাচাইয়ের জন্য আমরা কি কোনো অভিজ্ঞ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিয়েছি কখনো? আমাদের অধিকাংশই এসবের কিছুই করি না। নিজ নিজ দায়িত্বের জায়গায় উদাসীন থেকে আমরা শুধুই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে ভালোবাসি। অথচ এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দায়িত্বের জায়গাটুকু পালন করলে দেশের সামগ্রিক দুর্যোগ মোকাবিলা প্রস্তুতি অনেক বলিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারত।

ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আমরা হয়তো ঠেকাতে পারব না। তবে আমাদের সচেতনতা, প্রস্তুতি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অনেকাংশেই কমিয়ে দিতে পারে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা। আর মানুষের সৃষ্টি দুর্যোগ পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উদ্যোগ এবং সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]