সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ কী?—এই প্রশ্নের জবাব এককথায় দেওয়া সম্ভব তো নয়ই, এর জবাব আবার একেকজনের কাছে একেক রকম। তবে সাধারণ ও সরলীকৃত ধারণা থেকে বলা যায়, শুধু বেপরোয়া ড্রাইভিং বা রেষারেষিই নয়, এর বাইরেও সড়ক দুর্ঘটনা ও পথ-নৈরাজ্যের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের বাইরের এই ‘অনেক কারণ’-এর অন্যতম একটি হলো পথচারীদের বেপরোয়া রাস্তা পারাপার।
দুনিয়ার সব সভ্য দেশে যেখানে জেব্রা ক্রসিংয়ে পা-ফেলা মাত্র দূর থেকে আসা গাড়ি গতি কমিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, সেখানে আমাদের দেশে গাড়িচালকেরা এই নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। আবার পথচারীরাও জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হওয়ার চেয়ে ‘অন্যভাবে’ পার হতে বেশি পছন্দ করেন। অথচ প্রতিবছর ট্রাফিক সপ্তাহে ঘটা করে ব্যবহৃত হয় সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া স্লোগান, ‘জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হোন’। এই স্লোগান টাঙানো ব্যানারের পাশ দিয়েই পথচারীরা নিয়ম ভেঙে দৌড়ে রাস্তা পার হন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।
গতকাল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় পথচারীদের বেপরোয়াভাবে রাস্তা পারাপারের যে ছবি ছাপা হয়েছে, তা দেখে যে কারও গা শিউরে ওঠার কথা। ছবিতে কোমরসমান উঁচু কংক্রিটের স্থানান্তরযোগ্য সড়ক বিভাজক পার হয়ে কয়েকজনকে রাস্তা পার হতে দেখা গেছে। ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল দ্রুতগতির যানবাহন যেকোনো সময় তাঁদের পিষে দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দৃশ্য মোটেও বিরল কিছু নয়। ঢাকা শহরের রাস্তায় প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গের মতো এই দৃশ্য প্রতি মুহূর্তে যত্রতত্র দেখা যায়। হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটার কারণে এ–সংক্রান্ত খবরও নিতান্ত স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া উল্লিখিত ছবির পাশেই একটি খবর ছাপা হয়েছে, যার শিরোনাম, ‘চাঁদপুরে বাসের চাকায় পিষ্ট মা ও ছেলেসহ ছয়জন; ৩ জেলায় ছাত্রসহ নিহত আরও ৩’। এই রকমের খবর প্রতিদিন ছাপা হচ্ছে, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না। দুর্ঘটনা বন্ধে চালকদের বেপরোয়া ড্রাইভিং এবং পথচারীদের বেপরোয়া রাস্তা পারাপার থামানো যাচ্ছে না। দুর্ঘটনা বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকেও যে শতভাগ সক্রিয় তৎপরতা দেখানো হচ্ছে না, তা সড়ক পরিবহন সংক্রান্ত আইন কার্যকরে গেজেট প্রকাশ নিয়ে গড়িমসি দেখে বোঝা যায়।
গতকালেরই আরেকটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, বেপরোয়া মোটরযান চালানোর কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজার বিধান রেখে ২০১৮ সালে করা সড়ক পরিবহন আইন হয়েছিল ওই বছরেরই ৮ অক্টোবর। এই আইনে বলা আছে, সরকার গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে আইনটি কার্যকর করবে। কিন্তু ছয় মাসেও সরকার গেজেট প্রকাশ করেনি। গেজেট প্রকাশ নিয়ে রিট করার পর গেজেট প্রকাশের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না মর্মে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রুলে গেজেট প্রকাশে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে। সরকারকে দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। সরকার এত দিন গেজেট প্রকাশ না করে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন একটি আইন কার্যকর করা কেন ঠেকিয়ে রেখেছে, তা এক রহস্য।
সড়ক দুর্ঘটনা ঠেকাতে পথচারী তথা জনগণ, সরকার, চালক—সব পক্ষেরই আন্তরিক সহযোগিতা দরকার। অথচ কোনো পক্ষকেই এ বিষয়ে যথার্থ আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে না। চালক ও পথচারীকে বেপরোয়া এবং সরকারকে উদাসীন দেখা যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার মতো মহামারি থেকে বাঁচতে এই তিন পক্ষকেই দায়িত্বশীল ভূমিকায় আসতে হবে।