বন্দুক দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হবে না

সন্ত্রাসী হামলার পর শ্রীলঙ্কায় নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা
সন্ত্রাসী হামলার পর শ্রীলঙ্কায় নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা

ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় বিস্ফোরিত বোমা অবিশ্বাসের ধাক্কায় গোটা জাতিকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। খুব দুঃখের বিষয়, একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অতি নগণ্যসংখ্যক লোক অন্যদের হত্যা করতে এবং নিজেরা নিহত হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যখন একটি দেশের ছেলেমেয়েরা মানুষ হত্যা করতে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, তখন সেটি জাতির জন্য লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে এ ঘটনা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের কথা আমলে নিতে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতারই আভাস দেয়।

এপির একটি প্রতিবেদন বলছে, ‘তারা (সরকার) হামলাকারী গ্রুপটিকে আগে থেকেই চিনত, তারা অভিযানের লক্ষ্যবস্তু জানত, কোন সময় অভিযান চালানো দরকার ছিল তা তারা জানত, আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের গোপন আস্তানা কোথায় তা–ও তারা জানত, সবকিছুই শ্রীলঙ্কা সরকারের জ্ঞাতসারে হয়েছে।’ শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের এখন একটাই জিজ্ঞাসা: বিভিন্ন মসজিদ কর্তৃপক্ষ এবং দায়িত্বশীল রাজনীতিকেরা বারবার উগ্রপন্থী লোকজনের বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ করার পরও কেন সেসব উপেক্ষা করা হলো? অনেকের ধারণা, মুসলমানদের ভিটেবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্ছেদ করা এবং এর মাধ্যমে তাঁদের সামগ্রিক অর্থবল ও রাজনৈতিক গুরুত্ব কমিয়ে ফেলার জন্য একটা মোক্ষম অজুহাত দরকার। সেই অজুহাত সৃষ্টি করার জন্য ইসলামি উগ্রপন্থীদের বাড়তে দেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক খাতে মুসলিমরা বেশ সাফল্য দেখিয়েছে এবং অন্যান্য পেশায়ও তারা ভালো জায়গায় রয়েছে। তাদের এই অবস্থা থেকে অবনমিত করার জন্য অনেক আগে থেকেই একটি সমন্বিত চেষ্টা চলেছে।

কয়েক বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়েছে। মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলোতে এর আগে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭০ থেকে ১৯৮০–র দশকের তামিলবিরোধী তৎপরতার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওই সময়ে তামিলদের যেভাবে তাড়িয়ে বেড়ানো হতো, মুসলমানদের অবস্থা এখন প্রায় সে রকম। এখন কোথাও কোথাও গরিব মুসলমানদের তাদের ভাড়া করা বাসা ছেড়ে দিতে বলা হচ্ছে। এই হামলার পর এখন পুরো মুসলিম সম্প্রদায়কে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা ঢেকে ফেলেছে।

কয়েকজন সন্ত্রাসীর কারণে আমরা গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে জিম্মি করে ফেলতে পারি না। পিচ্ছিল ঢালু পথে পতনের দিকে যাওয়ার মতোই দুর্বল একটি সম্প্রদায়কে নিষ্ঠুরভাবে জব্দ করা খুব সোজা কাজ। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার, ১৯৭১ সালে সিংহলি, তামিল ও মুসলিমরা সহিংসতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে গভীর সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিল। আমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নাগরিকদের মধ্যে যে মৌলিক আচরণগত ত্রুটি আছে এবং এই ত্রুটি আমাদের কত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে, তা বুঝতে সেই সময়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

এখন আমরা সন্ত্রাসবাদের নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। বৈশ্বিক সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান—এ দুটোরই বলি হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানা সম্প্রদায়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বহু দেশ, অঞ্চল তথা গোটা বিশ্ব। নাইন–ইলেভেন পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসের এই নতুন যুগ নিজস্ব ইতিহাস সৃষ্ট করেছে। ২০১৫ সালের গোড়ায় সিরিয়ার জিহাদি গ্রুপগুলো ২০ হাজারের বেশি বিদেশি যোদ্ধাকে তাদের দলে ভিড়িয়েছে। এদের বেশির ভাগই তখন আইএসে যোগ দেয়।

পলিটিকো ম্যাগাজিন এদের ব্যাপারে বলেছে, ‘সিরিয়ার যুদ্ধে লড়াই করা আইএসের হাজার হাজার জঙ্গি এখন মানসিক যাতনা ও বিবেকের তাড়নায় আছেন। আইএস খেলাফত অবসানের পর এই ভ্রাম্যমাণ মুজাহিদেরা এখন বিশ্বের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ হিন্দুস্তান টাইমস টিভির একটি অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার এই বোমা হামলাকারীদের সঙ্গে সিরিয়ার আইএস জঙ্গিদের একধরনের যোগ থাকার আভাস পাওয়া গেছে।
দ্য ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকা বিষয়টি মাথায় রেখে শ্রীলঙ্কা সরকারকে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে। পত্রিকাটি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারকে সহনশীল অবস্থানে থাকতে বলেছে।

আমিন মালুফের লেখা ‘ইন দ্য নেম অব আইডেনটিটি: ভায়োলেন্স অ্যান্ড দ্য নিড টু বিলং’ বইটিতে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের বেড়ে ওঠা এবং মৌলবাদ বিস্তারের নতুন নতুন ধরন নিয়ে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হয়েছে। এই বইয়ে দেখানো হয়েছে, বেশির ভাগ উগ্রপন্থীর মগজে অতি শৈশবেই মৌলবাদী চিন্তার বীজ বুনে দেওয়া হয়। স্বেচ্ছায় অথবা পরিস্থিতির কারণে তারা সেই বীজ থেকে উদ্‌গত অঙ্কুর পরিচর্যা করে। পারিবারিক বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার–আচরণ, মূল্যবোধ ইত্যাদির কারণে তাদের ভেতরে সেই চেতনা বড় হতে থাকে।

এই লোকগুলো যখন সমাজ থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত হয়, তখন তাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়। তারা ভেতরে-ভেতরে ক্ষোভ পুষে প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যে লোকটা সব সময় স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু রাতারাতি খুনি হয়ে গেল, তাকে চোখ বন্ধ করেই উন্মত্ত বলে দেওয়া যায়। কিন্তু যেখানে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার খুনি ধর্মের নামে সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালায়, সেখানে তাদের আমরা নেহাত উন্মাদ বলে সাব্যস্ত করতে পারি না। তারা আসলে ‘নির্বোধ খুনি’ যারা সব সময় মনে করে তারা হুমকির মুখে আছে এবং রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহই একমাত্র সমাধান। এই অবস্থায় আমাদের এমনভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, যাতে কেউ যেন জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নিজেদের বঞ্চিত ও শোষিত বলে ভাবার অবকাশ না পায়। প্রত্যেকে যেন তার ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশের ন্যূনতম সুযোগ পায়। কেউ যখন বুঝতে পারে, তাকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে এবং তাঁর পরিচয়কে বিকশিত হওয়ার সব পথ বন্ধ করা হচ্ছে, তখন সে সহিংস হয়ে ওঠে। এই দিকগুলো আমাদের নিবিড়ভাবে মাথায় রাখতে হবে।

আমাদের অর্থমন্ত্রী মঙ্গলা সামারাবিরা জরুরি অবস্থা চলাকালে যথার্থই বলেছেন, ‘বন্দুকের শক্তি দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সহযোগিতার এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে সবার স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। সবাই দেশের মধ্যে সুরক্ষিত বোধ করবে।’

ইংরেজি থেকে অনূদিত
জীবন থিয়াগারাজা: শ্রীলঙ্কার সেন্টার ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের চেয়ারম্যান