সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রাজনীতি

ভারতে লোকসভার নির্বাচন শেষ হতে আর কয়েক সপ্তাহ বাকি আছে। এ সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সেটা হচ্ছে, এই নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কী ভূমিকা পালন করেছে?

ভারতে প্রচলিত ভাবনা এমন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সব সময় সন্দেহ করা উচিত, বিশেষ করে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে। ২০১৩ সালে, গত সাধারণ নির্বাচনের এক বছর আগে, আইআরআইএস নলেজ ফাউন্ডেশন এবং ইন্টারনেট অ্যান্ড মোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা, ১৬০টি আসনে (লোকসভায় ৫৪৩টি আসন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীর সংখ্যা এসব আসনের মোট জনসংখ্যার চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটি, যাঁরা কিনা নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁদের উপেক্ষা করার সাহস কোনো রাজনীতিবিদ দেখাননি।

যদি এটি তখন সত্যি হয়, তবে এটি এখন অনেক বেশি সত্য। আমি সম্প্রতি একটি তুলনামূলক গবেষণায় দেখেছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারকারীর সংখ্যা অবশ্যই ২০১৪ সাল থেকে বেড়েছে। ভারতে এখন প্রায় ৬২ কোটি ৫০ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং এর ৮০ শতাংশ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এ বছরের নির্বাচনের দিকে এই ৬২ কোটি ৫০ লাখ জোড়া চোখের নজর থাকতে পারে, যা ২০১৪ সালের চেয়ে আট গুণের বেশি।

সম্ভবত ভারতের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি এবং ভোটারদের ৪০ শতাংশের বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন। তবে রাজনীতিবিষয়ক সংবাদ ও মতামত জানতে তাঁরা কত ঘন ঘন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন, সে ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণা নেই।

ভারতে তিন কোটি মানুষ টুইটারে সক্রিয়; তবে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৪ কোটির বেশি। কাজেই টুইটারে রাজনৈতিক বিষয়ে প্রচার–প্রচারণা খুব একটা কাজে আসার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো টুইটার ব্যবহার করে জনসমাবেশ বা বৃহত্তর জনসভার আহ্বান করলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এটা প্রচলিত প্রচারাভিযানের বিকল্প হতে পারে না।

যাহোক, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এই বছর ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তারা এসব মাধ্যমে তাদের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো রাজনীতিবিদদের জন্য অপরিহার্য যোগাযোগ সরঞ্জামে পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপ হলো তাদের পছন্দের মাধ্যম, কারণ ভারতের মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের ৮২ শতাংশ অ্যাপটি ডাউনলোড করেছেন। একটি রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থ, জাতি বা ধর্মীয় পরিচয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত গোষ্ঠী তৈরি করতে পারে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই প্রযুক্তির মাস্টার, তারা সারা দেশে আনুমানিক ৫০ লাখ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালাচ্ছে। বিজেপির তথ্যপ্রযুক্তি সেলের প্রধান অমিত মালভিয়া গত মার্চ মাসে ঘোষণা করেন যে ‘আসন্ন নির্বাচনে মুঠোফোনে যুদ্ধ করা হবে...অন্যভাবে, আপনি বলতে পারেন যে এটা হবে হোয়াটসঅ্যাপ নির্বাচন।’

তবে সমস্যাটি হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার সব সময় নিরাপদ নয়। এখানে চাইলেই ভুয়া খবর ও বানানো ছবি প্রচার করা যায়। বিপদটা হলো যে অনেকে এসব ভুয়া খবরের ভিত্তিতে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। বিজেপির মনোভাব হলো, ভালোবাসা, যুদ্ধ এবং রাজনীতিতে সবই ন্যায্য। কিন্তু এতে ভারতীয় গণতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে।

কেননা, হোয়াটসঅ্যাপে প্রচার করা গুজবের ভিত্তিতে মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের দিনে বোমা হামলা হওয়ার পর সে দেশের সরকারের একজনের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করা। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে বিপদটা অন্য রকম, বিশেষ করে যখন তা ভুয়া রাজনৈতিক বার্তা প্রচারের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। চলমান নির্বাচনে, ‘ভুয়া সংবাদ’ প্রচার রোধে সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। এ ধরনের ভুয়া সংবাদ যারা ছড়াচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না এবং ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে নেই কার্যকর কোনো উদ্যোগ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যোগাযোগের একটি দুর্দান্ত ব্যবহারযোগ্য সেট, যা জনমত প্রকাশের বিষয়টিকে গণতান্ত্রিক করেছে। কিন্তু কিছু বিবেকবর্জিত রাজনীতিক, যাঁরা এসব মাধ্যমকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের অস্ত্র হিসেবে দেখেন, তাঁদের হাতে পড়ে এগুলো নিজেরাই গণতন্ত্র হারিয়ে ফেলছে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে আপনি যদি একবার ভুল লোককে ভোট দিয়েই ফেলেন, পরবর্তী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আপনি এ ব্যাপারে আর কিছুই করতে পারবেন না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী