খুঁজে বেড়াই গালিবের সেই শহরকে

গুজরাটে দেখেছি, উত্তর প্রদেশে দেখেছি; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এমন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আড়াই দশকের সাংবাদিকতার জীবনে কখনো দেখিনি।

কয়েক দিন আগেও একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল। রবি ঠাকুরের বাংলা, নজরুলের বাংলা। চৈতন্যদেবের বাংলা। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের বাংলা। এই শহরের হিন্দি পত্রিকাতেই ভগৎ সিংয়ের প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ। বয়স তখন সতেরো। বিষয় ছিল ‘বিশ্বজনীন সৌভ্রাতৃত্ব’। স্বাধীনতার বছরে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেব যখন চিরদিনের জন্য জন্মভূমি পাকিস্তান ছেড়ে চলে এলেন, তখন আশ্রয় নিয়েছিলেন এই কলকাতায়। কারণ, এই শহরে সুরের ভুবনে অসুর আর শয়তানের প্রবেশ ছিল নিষেধ।

এই কলকাতাই হয়ে উঠেছিল গুজরাট গণহত্যায় আক্রান্তের নিশ্চিত আশ্রয়। ১৯৮৪, গোটা দেশে যখন শিখরা আক্রান্ত, তখন এই শহরই ছিল তাদের নিরাপদ ঠিকানা। এই শহরের বালিগঞ্জ স্টেশন রোড থেকেই বের হয়েছিল একুশের প্রথম স্মরণিকা। একুশের প্রথম কবিতা সংকলন। প্রচ্ছদশিল্পী আর কেউ নন, সোমনাথ হোর। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাথি হয়ে গর্বের অন্ত ছিল না এই শহরের। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এই শহরের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকেই ইথারে বিজয়ের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল গোটা বাংলায়, বিশ্বে: ‘আমরা যুদ্ধে জিতেছি।’

আজ সব কেমন যেন বেমালুম উধাও। নিজের চেনা জায়গা নিজেরই কেমন অচেনা লাগে। পরিচিত মানুষকেও মনে হয় অপরিচিত। এমন তো ১০ বছর আগেও ছিল না। ভোট আসবে-যাবে, কিন্তু যে দেয়াল তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাকে ভাঙবে কে!

বেশ কয়েক বছর পর কয়েক দিন আগে আসানসোলে গিয়েছিলাম। আসানসোল পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ঝাড়খন্ড লাগোয়া এই শহরের ৭৫ শতাংশ হিন্দু। তাদের অর্ধেকই হিন্দিভাষী অবাঙালি। এখানে এখন দুর্গাপূজার মতোই রামনবমীর রমরমা। রামনবমী আর হনুমানজয়ন্তী নিয়ে বেপরোয়া উন্মাদনা। বিজেপি শুরু করলেও সমানে সমানে পাল্লা দিতে রাস্তায় তৃণমূল। কে কত বড় ‘হিন্দু’, তার উৎকট প্রতিযোগিতা। এক পক্ষ রাম সাজলে, আরেক পক্ষ হনুমান। চড়া আওয়াজে হিন্দি গান, প্রকাশ্যে তরবারি উঁচিয়ে পদযাত্রা। উগ্র হিন্দুত্বের উদ্ধত আস্ফালন।

সংখ্যালঘু মহল্লাগুলো কেমন যেন সিঁটিয়ে থাকছে। ভয় দেখাচ্ছে আরএসএস-বিজেপি। ভয় কাটানো নয়, সেই ভয়কেই আরও জাঁকিয়ে বসাচ্ছে তৃণমূল। উভয়ই দুদিক থেকে ফায়দা তুলতে মরিয়া। কম্পিটিটিভ কমিউনালিজম, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। বিপরীতে মানুষ চাইছে শান্তি। কদিন আগেও এ রাজ্যে ছিল না কোনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা।

বামপন্থীদের ঘোর বিরোধীরা পর্যন্ত এ নিয়ে কখনো সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে পারেননি। পায়ের তলায় জমি ছিল না আরএসএসের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ, এই রাজ্যে বিজেপিকে ডেকে আনা। সংঘ পরিবারের কাছে তিনি ‘সাক্ষাৎ মা দুর্গা’। দেড় দশক আগে মোহন ভাগবৎ, মদন দাস দেবীর মতো কট্টর আরএসএস নেতাদের উপস্থিতিতে যিনি অকপটে বলেছিলেন, ‘যদি আপনারা মাত্র ১ শতাংশ সমর্থন দেন, তবেই আমরা অবাক করে দেব।’ আট বছরে সত্যিই অবাক করে দিয়েছেন। এখন এই রাজ্যেও ঘটে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা। বসিরহাট, আসানসোল, রানীগঞ্জ, ধুলাগোড় থেকে কাঁকিনাড়া।

মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও তৃণমূল দুই মৌলবাদকে সমানে তোলা দিয়ে এসেছে। একদিকে রামনবমী, হনুমানজয়ন্তী; অন্যদিকে ইমাম ভাতা, মুয়াজ্জিনদের ভাতা। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যেই ইমামদের জন্য আড়াই হাজার টাকা, মুয়াজ্জিনদের জন্য এক হাজার টাকা ভাতা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। এতে মেরুকরণ তীব্র হলে হিন্দু ভোট পেতে দুর্গাপূজার উদ্যোক্তাদের ১০ হাজার টাকা করে অনুদান।

টাকার অভাবে রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা বাড়ে না। ঝাঁ–চকচকে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল রয়েছে, টাকার অভাবে হয় না চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ। জেলায় জেলায় প্রাইমারি স্কুলের সম্প্রসারণ হয় না টাকার অভাবে। টাকার অভাবে হয় না সেতু মেরামত। অথচ পূজা কমিটিগুলোকে অনুদান—সব মিলিয়ে খরচ ২৮ কোটি টাকা। শুধু তা–ই নয়, বিদ্যুৎ বিলে ছাড়। কলকাতায় বেসরকারি সংস্থা অন্যভাবে পুষিয়ে নিলেও জেলায় সব দায়ভারই গিয়ে পড়ে সরকারি বিদ্যুৎ পর্ষদের ঘাড়ে।

আর এই মেরুকরণের রাজনীতিতে তৃণমূলের চেয়ে বেশি ফায়দা লুটছে বিজেপি। বাড়ছে, বেড়ে চলেছে আরএসএসের শাখা। ২০১১ সালে ছিল ৩৫০। এখন বেড়ে ১ হাজার ৪০০। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ইউনিট। জেলা, ব্লক, অঞ্চল মিলিয়ে ১ হাজার ৫০০–র কাছাকাছি।

ঐতিহাসিক রেড রোডে এখন পূজা কার্নিভ্যাল। কুচকাওয়াজের জন্য ১৮২০ সালে ব্রিটিশ ভারতে এই বুলেভার্ড তৈরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানেই নামত বিমান। এত দিন এই চওড়া বুলেভার্ড ব্যবহৃত হতো ঈদের নামাজের জন্য। প্রায় দুই লাখ মানুষ এখানে নামাজে অংশ নেয়। প্রতীকী বার্তা দিতে তাই রেড রোডেই তিন বছর ধরে পূজা কার্নিভ্যাল। মসৃণ রাস্তা বেয়ে একের পর দুর্গাপ্রতিমার বর্ণময় শোভাযাত্রা। রাস্তার এক পাশে মূল মঞ্চ। মুখ্যমন্ত্রী থেকে মন্ত্রিসভার সদস্যরা। দর্শকদের জন্য জায়ান্ট স্ক্রিন। আয়োজনে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর। আগে বিসর্জন, মহররম—সব ধর্মের উৎসব হয়েছে একসঙ্গে। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। এখন হচ্ছে।

নির্বাচনে তাই সহজেই ইস্যু হয়ে যায় এনআরসি অনুপ্রবেশ। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর হুংকার, ‘এবার (পশ্চিম) বাংলায় এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) আনব, তার আগে নাগরিকত্ব আইন (সংশোধনী) পাস করানো হবে। অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে খুঁজে তাড়াব।’ অমিত শাহর কথায় অনুপ্রবেশকারী মানে শুধু মুসলিমরা, বাকিরা সবাই শরণার্থী। হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত ইস্যু। বেকারত্ব, কৃষকের দুর্দশা, দুর্নীতি। তৃণমূল-বিজেপির আসন রফা এখন আর গোপন নয়। ওপেন সিক্রেট।

তবে আমাদের বিশ্বাস এখনো বাংলার মাটিতে। আমাদের প্রত্যয়, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত। ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে ছাড়িয়ে মাথা তুলেছিল তেভাগার লড়াই। ভরসা পাই আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমামের ওপর। পুত্র খুনের পরেও জনতার উদ্দেশে যিনি বলেন, চোখের বদলে চোখ কোনো সমাধান নয়। ভিন্নধর্মের একটি মানুষও আক্রান্ত হলে তিনি আসানসোল ছেড়ে চলে যাবেন। ভরসা রাখি বামপন্থী, শুভবুদ্ধির সেই সব মানুষের ওপর, যারা রাতের পর রাত জেগে বস্তি, মহল্লা পাহারা দিয়েছে। রুখে দিয়েছে কুৎসিত ষড়যন্ত্র।

ভরসা রাখি আমার শহরের ওপর। এই শহরেই দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়ি ছিল কলিম শরাফীর নিরাপদ আশ্রয়। দিল্লি ফিরে পার্সিতে লেখা চিঠিতে সেই কবে গালিব লিখেছিলেন, ‘সবারই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে এমনও একটা শহর আছে।’

শান্তনু দে: কলকাতার সাংবাদিক