মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা-সেনারা বিস্মৃতির পথে

মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাস নিয়ে চর্চা হয়েছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে স্বাস্থ্য খাতের যে ব্যাপক ভূমিকা ছিল, তা আমরা যেন ভুলেই গেছি। আহত মুক্তিযোদ্ধা ও অগণিত শরণার্থীর চিকিৎসা দেওয়া, নিহত যোদ্ধাদের মরদেহ সত্কার—স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এসব ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলেছে একাত্তরের যুদ্ধের সময়। মুক্তিযুদ্ধের ভেতর কারা এই চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, কীভাবে এই কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে, তার সুশৃঙ্খল কোনো ইতিহাস নেই। সেই বিস্মৃত ইতিহাস তুলে আনার ইচ্ছা থেকে আমরা দুজন কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছি। আশা করছি, আমাদের গবেষণা গ্রন্থটি অচিরেই প্রকাশিত হবে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে বিবিধ ধারার সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত এবং আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগ ছিল, তথ্যসূত্রসহ তার বিস্তারিত আলোচনা থাকবে আমাদের প্রকাশিতব্য গ্রন্থে। আজকের এই লেখায় শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নেওয়া স্বাস্থ্যবিষয়ক আদি পর্বের উদ্যোগের কিছু তথ্যের কথা উল্লেখ করতে চাই, সেই সঙ্গে একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। আমরা জানি, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়, যা এখন মুজিবনগর নামে পরিচিত। নানা প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টন, পদায়ন ইত্যাদি শেষে সেই সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২ মে ১৯৭১ সালে। ওই দিনই গঠন করা হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

উল্লেখ্য, সেনা অধিদপ্তরের পর বাংলাদেশের যে অধিদপ্তরটি প্রথম যাত্রা শুরু করে, সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মন্ত্রিসভার সেই বৈঠকে চিকিৎসক তোফাজ্জল হোসেন—যিনি টি হোসেন নামে পরিচিতি ছিলেন—তাঁকে ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াও শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণসহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আদেশের বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নিজ হাতে লেখা নোট এবং টাইপ করা আদেশপত্র মুক্তিযুদ্ধের দলিলাদিতে সন্নিবেশিত হয়েছে।

তাজউদ্দীন আহমদ লেখেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের মে মাসের ২ তারিখে ডা. টি হোসেনকে (এমএস, এফআরসিএস) মহাপরিচালক নিয়োগের মাধ্যমে। সরকার গঠনের সময় ডা. হোসেন আমাদের সহচর হিসেবে ছিলেন। পাক সেনাবাহিনীর সেই অভিযানের পরে দুই সপ্তাহের জন্য আমাদের মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য তাঁর ক্লিনিকে আশ্রয় নিয়েছিল। ঢাকায় প্রায় ছয় লাখ টাকা মূল্যমানের সরঞ্জামসহ তাঁর নার্সিংহোম ফেলে তিনি এসেছিলেন। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের সহযোগিতা করতে এসেছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হতে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাঁর নার্সিংহোম থেকে আমরা সকলেই চিকিৎসা নিতাম। কলকাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রজীবনের প্রস্তুতির সময় থেকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চালু করতে চিকিৎসা পেশায় বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে একমাত্র ডা. হোসেনকেই পাওয়া গিয়েছিল।’

নানা দলিল পর্যালোচনা করে আমাদের মনে হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শুরু হয় অনেকটা ডা. টি হোসেনের হাত ধরে। কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের উপহাইকমিশনার হোসেন আলী সব বাংলাদেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর কলকাতার হাইকমিশন অফিস কার্যত বাংলাদেশ সরকারের অফিসে পরিণত হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মিশন অফিসের ভবনে দুটি কক্ষে কাজ শুরু করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রথমেই যে কাজটি করে তা হলো, স্বাস্থ্য জনশক্তিকে সংগঠিত করা। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশি সব চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য মেডিকেল জনশক্তিকে অফিসে রিপোর্ট করার জন্য বলা হয়। শুরুর প্রথম তিন মাসের মধ্যেই এই অধিদপ্তর উদ্বাস্তুদের ব্যাপক মেডিকেল সমস্যা মোকাবিলা করার কাজটি হাতে নেয়।

যেসব চিকিৎসক ও প্যারামেডিকেল স্টাফ সদর দপ্তরে এবং সীমান্ত এলাকায় রিপোর্ট করেছেন, তাঁদের মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে পুনর্বাসিত করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৪০০-এর বেশি চিকিৎসাকর্মীকে তখন নিয়োগ দেওয়া হয়। জানা যায়, উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ৬০ লাখে পৌঁছানো পর্যন্ত ডা. হোসেন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব উদ্বাস্তু শিবিরই পরিদর্শন করেছিলেন। এরই মধ্যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য সংগঠন এবং আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলো শরণার্থীদের জন্য ওষুধপথ্যসহ নানা রকম সাহায্য পাঠাতে শুরু করে। এসব মেডিকেল ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ, বিতরণ এবং হিসাব রাখার দায়িত্ব তখন ছিল ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের, যার নেতৃত্বে ছিলেন কামারুজ্জামান। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ডা. জয়নাল আবেদীন। তিনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিকিৎসক নির্বাচন করে তাঁদের নাম পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য বলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর খানিকটা দর-কষাকষি করে এমবিবিএস চিকিৎসকদের জন্য দৈনিক ভাতা ১৫ রুপি এবং এলএমএফ চিকিৎসকদের জন্য দৈনিক ভাতা ১০ রুপি নির্ধারণ করে। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় রেড ক্রসের ব্যানারেও অনেক চিকিৎসাকর্মীকে কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসাকর্মী শরণার্থী শিবিরের চিকিৎসাসেবায় এবং রণাঙ্গনের বিভিন্ন হাসপাতালে ও ড্রেসিং স্টেশনে কাজ করেছেন।

এখানে উল্লেখ্য, প্রবাসী সরকার প্রথম থেকেই স্বাস্থ্য মহাপরিচালক সচিবের পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। তবে এ নিয়ে কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও সৃষ্টি হয়েছিল। একটি তথ্য থেকে আমরা জানতে পারি, একদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেখতে পান যে ডা. টি হোসেন প্রখর রোদের মধ্যে হেঁটে হেঁটে অফিসে আসছেন। তিনি জানতেন, তখনকার ঢাকায় আয়-রোজগার গাড়ি-বাড়ির মালিকানার দিক থেকে ডা. টি হোসেনের সমকক্ষ পেশাজীবী প্রবাসী সরকারে নেই। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাঁর ক্লিনিক থেকে সপরিবার চিকিৎসা নিয়েছেন। যুদ্ধের প্রয়োজনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি প্রবাসী সরকারে যোগ দিয়েছেন, অথচ তাঁর যাতায়াতের জন্য কোনো গাড়ির বরাদ্দ নেই দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সিলমোহর দেওয়া সেই চিরকুটে ডা. হোসেনকে একটি গাড়ি বরাদ্দের আদেশ দেন। কিন্তু পদমর্যাদার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেই গাড়ি বরাদ্দ করেনি প্রবাসী সরকারের সাধারণ প্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে একাত্তরের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শিলিগুড়ি সম্মেলনের আগে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের পরিকল্পনার খসড়া অনুমোদনের পাশাপাশি নিজ হাতে লিখে ডা. টি হোসেনকে স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন।

ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস মিশন অফিস থেকে সরিয়ে কলকাতার ৪৫ প্রিন্সেস স্ট্রিটে ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রীর অফিসের চার তলায় স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তখন রেডক্রস এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস ছিল পাশাপাশি। এই দুই অফিসের বিভাজনে তখন ব্যবহার করা হয়েছিল নেহাত একটি চটের তৈরি পর্দা। পরে জুলাই মাসে স্বাস্থ্যসচিবের অফিস প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির আবাস কাম অফিস ভবনে স্থানান্তর করা হয়। অবশ্য সেই ভবনের বারান্দাটিকেই রূপান্তরিত করা হয়েছিল স্বাস্থ্যসচিবের অফিসে। এমনি নানা রকম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনবলে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হন পরিচালক ডা. কে এ জামান, উপপরিচালক ডা. আহমেদ আলী, দুজন সহকারী পরিচালক ডা. মো. ফরিদ ও ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, মেডিকেল অফিসার মেসবাহুন নাহার এ তাহেরা খাতুন এবং অধিদপ্তরের বিতরণ কর্মকর্তা হিসেবে নাসিমা রহমান ও অফিস সহকারী হিসেবে আক্তার জাবিন আহমেদ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে প্রথম দিকে শরণার্থী শিবিরে অতি ঘন জনসংখ্যা, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের অভাব, সর্বোপরি খাদ্যাভাবের কারণে সৃষ্ট নানা রকম মহামারি ও অপুষ্টিজনিত রোগব্যাধি মোকাবিলা করতে হয়েছে। পাশাপাশি, রণাঙ্গনে বিস্তৃত সব কটি সেক্টরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, নানা রকম ড্রেসিং স্টেশনে জনবল ও মেডিকেল সাপ্লাই জোগান দেওয়ার দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে।

বছরের দ্বিতীয়ার্ধে যুদ্ধে যখন মুক্তিযোদ্ধারা আহত হতে শুরু করেন, তখন প্রয়োজন দেখা দেয় দীর্ঘমেয়াদি রোগনিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের। যুদ্ধের পরপরই ডা. আর জে গার্স্ট আর ভ্যালেরি এ টেইলরের অপরিসীম সহযোগিতায় যে ‘পঙ্গু হাসপাতাল’ এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি হয়, তার বীজ বপন হয়েছিল ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালেই।

আমরা প্রতিবছর ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করে থাকি ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন নিজস্ব একটি সশস্ত্র বাহিনী দিবস আছে, তেমনি আমরা প্রস্তাব করছি ২ মে বাংলাদেশের একটি নিজস্ব ‘স্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ দিবস হোক। এই দিন দেশবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে পারবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বাস্থ্য-সৈনিকদের অপার ত্যাগ এবং তিতিক্ষাকে।

শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
[email protected]

খায়রুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর
[email protected]