রঙিন হলো না মেয়েদের উৎসব

বয়সভিত্তিক ফুটবল আসরে মেয়েরা নিয়মিত সাফল্য পাচ্ছেন
বয়সভিত্তিক ফুটবল আসরে মেয়েরা নিয়মিত সাফল্য পাচ্ছেন

বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ৩ মে ফাইনাল দেখতে এসেছিলেন শাহাদাৎ হোসেন। বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপে বাংলাদেশের প্রতি ম্যাচেই শ পাঁচেক দর্শকের একটা দল নিয়ে মাঠে আসতেন আরামবাগের এই যুবক। ফাইনালেও বাংলাদেশ ফুটবল সাপোর্টার্স ফোরামের এই উদ্যোগের ব্যতিক্রম হয়নি। যদিও অন্যান্য দিনের মতো বাদ্যি-বাজনা নিয়ে ওই দর্শকদের স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। কিন্তু তারপরও গ্যালারিতে চিৎকার করে কৃষ্ণা রানী, তহুরা খাতুনদের সমর্থন দিয়েছেন সবাই।

সাফ ও এএফসির বিভিন্ন বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট কয়েক বছর ধরে ঢাকায় আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। কিন্তু মেয়েদের আন্তর্জাতিক প্রীতি টুর্নামেন্ট এবারই প্রথম। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার নামে টুর্নামেন্ট করায় এই আয়োজন পেয়েছে বাড়তি মাত্রা। টুর্নামেন্টের লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ভারতীয় মডেল অর্চনা বিজয়া। একদল রুশ নৃত্যশিল্পী অনুষ্ঠানে চোখ ধাঁধানো নাচ উপহার দিয়েছিলেন। ‘এগিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ স্লোগানে নারী নির্মাতাদের নিয়ে সাতটি টেলিভিশন নাটক তৈরি করা হয়। যেগুলো প্রচার করা হয়েছিল বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভিতে।

সংগীতশিল্পী মমতাজ, কনা, এলিটা, পড়শী, দোলা ও কুমকুমকে নিয়ে তৈরি করা হয় টুর্নামেন্টের থিম সং। আর জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান টুর্নামেন্টের শুভেচ্ছাদূত হয়ে সবাইকে মাঠে এসে খেলা দেখতে আহ্বান জানান। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা টুর্নামেন্টের থিম ভিডিওর ধারা বর্ণনা করেন।

২২ এপ্রিল শুরু হয় টুর্নামেন্ট। এর ১০ দিন আগে ফুটবল তারকা ভালদেরামার দেশ কলম্বিয়ার দুই নারী ফুটবলার জেসিকা হুরতাদো ও ক্যাথেরিন ফ্যাবিওলা কাস্ত্রো আসেন মেয়েদের উজ্জীবিত করতে। ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে খেলা এই দুই ফুটবলার নানা বিষয়ে আঁখি খাতুন, মনিকা চাকমাদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।

এবারের খেলার সম্প্রচার ও ধারাভাষ্যও আলাদা করে সবার নজর কেড়েছে। ম্যাচ শুরুর আগে ও পরে সঞ্চালক হিসেবে দেখা গেছে সাবেক মিস ওয়ার্ল্ড অস্ট্রেলিয়া ইরিন ভিক্টোরিয়া হল্যান্ডকে। টেলিভিশনের সুবাদে ইউরোপিয়ান ফুটবলের স্বাদ ঘরে বসে এখন নিয়মিতই নিচ্ছেন দর্শকেরা। কিন্তু নিম্নমানের টেলিভিশন সম্প্রচারের কারণে এত দিন এই দর্শকেরাই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন ঘরোয়া ফুটবল থেকে। অথচ এবারের বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে যেন নতুন করে জেগে ওঠেন দর্শকেরা। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলসহ প্রথম আলোর ফেসবুক পেজেও দেখা গেছে খেলা। ম্যাচে ইংরেজি ধারাভাষ্য দিয়েছেন পল ম্যাকসফিল্ড ও শেজাদ হক। এবারই প্রথম মেয়েদের টুর্নামেন্টে ম্যাচসেরার পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে ৫০০ ডলার। একটা টুর্নামেন্ট সফল করতে আর কীই–বা লাগত? কিন্তু কে জানত, এমন দুর্দান্ত আয়োজনের শেষটা হবে হতাশায় মোড়ানো? ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে ফাইনাল বাতিল করেন আয়োজকেরা। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও লাওসকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। ফাইনাল মাঠে না গড়ানোয় স্বাভাবিকভাবেই হতাশ স্ট্রাইকার তহুরা খাতুন, ‘আমরা খেলতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু মানবিক দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফেডারেশন। এত দর্শক এসে খেলা না দেখে ফিরে গেছেন বলে বেশি খারাপ লেগেছে। অনেক দূর থেকে ফুটবলারদের অভিভাবকেরা এসেছিলেন। তাঁরাও ফিরে গেছেন।’

পুরুষ ফুটবলের তুলনায় মেয়েদের ম্যাচে এমনিতেই দর্শক বেশি আসে গ্যালারিতে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লড়াই করে উঠে আসা তহুরা, মনিকারা ম্যাচ জিতে বাংলাদেশকে আনন্দে ভাসান বলেই মেয়েদের ফুটবলে এমন উন্মাদনা। আর এই কারণেই হয়তো মেয়েদের ফুটবলে ইদানীং দর্শক হুহু করে বাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু বিভিন্ন বয়সভিত্তিক আসরেই এই মেয়েরা নিয়মিত সাফল্য পাচ্ছেন, কিন্তু একটা জায়গায় এসে আটকে গেছে মেয়েদের ফুটবল। সত্যিকারের জাতীয় দল গড়ে ওঠেনি বলে তহুরা, মনিকা, মারিয়াদেরই প্রতিনিধিত্ব করতে হচ্ছে শীর্ষ পর্যায়ে।

গত মার্চে নেপালে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে হারের ধাক্কাটা বয়সভিত্তিক দলের প্রভাব বলেই মনে করেন অনেকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বলে এবার বঙ্গমাতার ফাইনালটাও হলো না। হলো না মেয়েদের সত্যিকারের শক্তিমত্তা যাচাই। অথচ মাঠ খেলার উপযোগীই ছিল। জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের সাবেক ম্যানেজার কামরুন নাহার ডানা বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছেন না, ‘এভাবে খেলা বাতিল করে দর্শকদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু লেগেছে। মাঠ খেলার উপযোগী ছিল বলেই জেনেছি। তবে কি আমরা ওদের সঙ্গে হেরে যাব ভেবেই খেলিনি? খেলেও যদি ফাইনালে হারতাম, এতে লজ্জার কিছু ছিল না।’

একটা টুর্নামেন্ট ঘিরে বাফুফের এত আয়োজন। তবু শেষ পর্যন্ত যুগ্ম চ্যাম্পিয়নের আক্ষেপ নিয়ে ঘরে ফিরেছেন কৃষ্ণা, মনিকারা। তাহলে মাঠের খেলা রেখে এভাবে ট্রফি ভাগ করে সত্যিকারের লাভটা কার হলো?

বদিউজ্জামান সাংবাদিক