ইরানের বিরুদ্ধে হুমকিতে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন আকস্মিক ও অব্যাখ্যাতভাবে তেহরানের বিরুদ্ধে অব্যাহত শক্তি ব্যবহার করার যে হুমকি দিয়েছেন, তার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা এক নতুন উচ্চতায় উঠেছে। কিন্তু এর প্রভাব শুধু এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রাণঘাতী বিষের মতো, তাদের পারস্পরিক শত্রুতার প্রভাব ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীল হয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

জন বোল্টন ইরানকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিমানবাহী রণতরি পাঠানোর সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করেননি, তবে জন বোল্টন ইরান এবং বিশেষ করে ইরানের রাষ্ট্রবহির্ভূত মিত্রগোষ্ঠী ও ভাড়াটে বাহিনীগুলোকে একমাত্র উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এই গোষ্ঠীগুলো সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন এবং গাজাসহ বেশ কয়েকটি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে গভীরভাবে জড়িত এবং এরা যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে।

বোল্টন বলেছেন, বেশ কিছু সমস্যা, উসকানিমূলক আচরণ ও হুমকির পাল্টা জবাব হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরান সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় না, তবে আমরা যেকোনো হামলা মোকাবিলার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত, হোক সেটা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের বা ইরানের নিয়মিত বাহিনীর হামলা।’

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ইরান এখন হামলার মেজাজে রয়েছে। যেকোনো সময় এই হামলা হতে পারে। যদি তারা তৃতীয় পক্ষ যেমন মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মাধ্যমে হামলা চালায়, তাহলে আমরা তার জন্য সরাসরি ইরানের নেতৃত্বকে দায়ী করব।’ তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের হামলার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছে।

জন বোল্টন এবং মাইক পম্পেও হয়তো এটা ভেবে চিন্তিত যে ইরান তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কঠোর করার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য গাজাকে ব্যবহার করছে বা অন্য কোথাও বড় কোনো পরিকল্পনা করছে।

সিরিয়ায় অব্যাহত সংঘাত ইরানকে হুমকি দেওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হতে পারে। সিরিয়ায় চলমান দ্বন্দ্বের জন্য ওয়াশিংটন রাশিয়ার চেয়ে ইরানকে দায়ী করছে। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর সিরিয়ায় ঘাঁটি তৈরি করেছে এবং মস্কো–সমর্থিত বাশার আল–আসাদের শাসনের প্রতি অনুগত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে। বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যকর্মীদের মতে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় হামা ও ইদলিব শহরে ব্যাপক বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এমনকি বেশ কয়েকটি হাসপাতালেও হামলা চালানো হয়েছে। এতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে এবং বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

এই হামলা আসাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ইদলিব শহর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা কি না তা স্পষ্ট নয়, যা সিরিয়ার বিদ্রোহীরা সর্বশেষ দখল করেছে। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত সপ্তাহে এ সম্ভাবনার কথা অস্বীকার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, নতুন আক্রমণ সম্ভবত ইরানের নেতৃত্বে কোনো স্থলবাহিনী চালাবে। পুতিনকে সমালোচনা করার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ট্রাম্প সিরিয়ার সহিংসতার জন্য ইরানকেই দায়ী করেন এবং এ জন্যই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই হুমকি।

ওয়াশিংটনের হতাশা ইরানকে হুমকি দেওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের নীতিগুলো সবখানে অব্যাহতভাবে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ওয়াশিংটনের এই হতাশা। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের বোমা হামলা কেবল বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি করতে এবং আন্তর্জাতিক নিন্দা অর্জনের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটরা সৌদি যুদ্ধাপরাধীদের সহায়তা ও সহযোগিতা করার জন্য ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছে। তারা এখন সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিতে চায়।

ইরাকে অবশিষ্ট মার্কিন সেনার উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক ক্রমেই বাড়ছে। তেহরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ইরাকের ক্ষমতাসীন শিয়া রাজনীতিকদের বেশির ভাগ স্পষ্ট করেছে যে তারা তাদের দেশকে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দিতে চায় না।

না ট্রাম্প বা না তাঁর উপদেষ্টারা ইরানের সরকার পরিবর্তনের জন্য ঐতিহ্যগত মিত্রদের ওপর আর নির্ভর করতে পারছেন না। ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় দেশগুলো তেহরানের সঙ্গে জাতিসংঘের অনুমোদিত ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিকে সমর্থন করে চলছে, যে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর বেরিয়ে যায়, যখন কিনা ইরান জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থার দেওয়া সব শর্ত মনে চলছিল।

বিশ্বশক্তির সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তির সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর থেকে যে যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল, গত নভেম্বরে সেগুলো পুনর্বহাল করে যুক্তরাষ্ট্র। জাহাজ নির্মাণ, বাণিজ্য, ব্যাংক, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা আবার কার্যকর হয়। এই খাতগুলো ইরানের অন্যতম অর্থনৈতিক ভিত্তি। ওয়াশিংটনের এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় কেবল ইরানই ছিল না, যারা এই দেশের সঙ্গে ব্যবসা করবে কিংবা তেল কিনবে, তাদের ওপরও মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তবে ভারত, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ইতালি, চীনকে ছয় মাস নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়। পরে তুরস্কও ইরানি তেল কেনার ক্ষেত্রে এ ছাড় চায়। তবে এখন আর সময় বাড়াচ্ছেন না ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র ১ মে থেকে ইরানের কাছ থেকে আর কোনো তেল কেনা যাবে না বলে ঘোষণা করেছে।

তবে ধারণা করা হচ্ছে চীন, তুরস্ক ও ভারত ইরান থেকে তেল কেনার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করবে। চীন গত মাসে ইরানের সঙ্গে বৈধ ‘সহযোগিতার’ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ না করার জন্য অনুরোধ করেছে।

এখন ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই হুমকি আদৌ ইরানকে কোনো ধরনের হামলা থেকে বিরত রাখবে কি না সেটাই দেখার বিষয়।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
সাইমন টিসডাল: দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও কলাম লেখক