বিদ্রোহ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের অংশ

লে. কর্নেল কাজী নূর–উজ্জামান
লে. কর্নেল কাজী নূর–উজ্জামান

৬ মে ছিল মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লে. কর্নেল কাজী নূর–উজ্জামানের মৃত্যুদিবস। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর ব্যক্তিত্বের এক বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বিদ্রোহ। নিজের নৈতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন কিছুর মুখোমুখি হলে তিনি সব সময়ই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যা–কিছু তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি, তিনি তার প্রতিবাদ করেছেন।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার সামরিক স্টাফ কলেজে দুই ছাত্র রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করা একটি নথিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান; দুজনেই ছিলেন বাঙালি। একজন কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান, অন্যজন তাঁরই দীর্ঘদিনের বন্ধু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সালাউদ্দীন আমিন। অতি সরল একটি যুক্তিতে তাঁরা এই প্রবল সাহস প্রদর্শন করেছিলেন: পাকিস্তানের সংবিধান ও জনগণের প্রতি আনুগত্যের শপথ তাঁরা নিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির প্রতি নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকেও নৈতিক মানদণ্ডে আর যখন গ্রহণ করা যায়নি, সেটাকে ছুড়ে ফেলার কাজেও সামনের সারিতে থেকেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান অবসর ভেঙে ফেরত এসেছিলেন যোদ্ধার ভূমিকায়, তিনি গণমানুষের পক্ষে আমৃত্যু লড়েছেন বীর যোদ্ধার মতোই।

২.

কাজী নূর-উজ্জামানের স্মৃতিকথায় বেশ কয়েকটি ঘটনায় পূর্ব বাংলার প্রতি পাঞ্জাবি সামরিকতন্ত্রের হীন মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। একটি ঘটনায় মধ্যাহ্নভোজের আড্ডায় দুই বিখ্যাত বাঙালি সাবেক আইজি ইসমাইল সাহেব ও আবুল হাসনাত সাহেব বিষয়ে আইয়ুব ও তাঁর পারিষদবর্গ পরচর্চায় মাতেন, এ দুজনকে সম্পূর্ণ অযোগ্য হিসেবে মত দেন। আইয়ুব মন্তব্য করেন, ‘আবুল হাসনাতকে আমি আমার আর্মিতে ল্যান্সনায়েকেরও মর্যাদা দিতাম না।’ কাজী নূর-উজ্জামান নিজের মনের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন: ‘চারদিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে...আইয়ুবের কথাবার্তায় বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রতিফলিত হচ্ছিল। আমি বিব্রত বোধ করতে থাকি কিন্তু জাকের হোসেন (ইনিও ছিলেন একজন সাবেক বাঙালি আইজি) আইয়ুবের কথায় সায় দিয়ে হাসি ভরে উপভোগ করছিলেন মনে হলো। এ ধরনের বাঙালি চাটুকারদের প্রতি আমার একটা ঘৃণা জন্মাল।’ (নির্বাচিত রচনাবলি, কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান)

এই চিন্তা থেকেই ২৫ মার্চ হানাদাররা আতঙ্কে বিমূঢ় করে দিতে চেয়েছিল জাতিকে। কিন্তু তারা টের পায়নি যে এই জাতির রসায়নে গভীর পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই প্রতিরোধের সারিতে রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, শ্রমিক, চলচ্চিত্রনির্মাতা, কবি, সাংবাদিক, সামরিক সদস্য—সবাই ছিলেন। কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামানের ১৫ বছরের ছেলে নাদিম সেদিন রাত ৩টায় রক্তস্নাত নগরী ঘুরে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বাড়িতে ফেরত এসেছিলেন বন্দুক সংগ্রহ করতে। তাঁর স্ত্রী সুলতানা সারওয়াত আরা জামান, দুই কন্যা অধ্যাপক নায়লা জামান খান ও লুবনা মারিয়ম, পুত্র নাদিম ওমর, সবাই মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তিগত ভূমিকা রেখেছেন। ৭ নম্বর সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর নাজমুল হক ২৬ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়িতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় শাহাদত বরণ করলে কাজী নূর-উজ্জামান দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

৩.

রণক্ষেত্রে তাঁর একজন সহযোদ্ধা এ কাইয়ূম খান স্মৃতিচারণায় (ডেইলি স্টার, ৬ মে ২০১২) উল্লেখ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ পুনর্গঠনে যুক্ত করার মুক্তিযুদ্ধজাত আকাঙ্ক্ষার কথা। নতুন দেশ গড়ে তোলায় তাঁর যোদ্ধাদের উৎসাহ আর আকুতির কথা নূর-উজ্জামান আমৃত্যু স্মৃতিচারণা করেছেন। সরকার শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দেশ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল, কর্নেল নূর–উজ্জামান এই পরিকল্পনার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। মত পাল্টে মুক্তিফৌজ ভেঙে দিয়ে যখন তাঁদের ৫০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করা হলো, কাজী নূর-উজ্জামান বিপর্যস্ত বোধ করলেন এবং বেসামরিক জীবনে ফিরে গেলেন। জাতীয় পুনর্গঠনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী বহু হতাশা, হানাহানি ও লুণ্ঠনও বহুলাংশে অসম্ভব হতো, এমনটাই মনে করতেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনে ব্যবহার করা হলে একদম সূচনা থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গতিমুখ বদলে যেত, এই ধারণার সমর্থন আমরা পাব বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতেও, ‘অন্যদিকে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দিতে হুকুম দিলেন।... ন্যাশনাল গার্ড ও মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যে প্রেরণা ছিল, পাকিস্তানকে গড়বার জন্য তা ব্যবহার করতে নেতারা পারলেন না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান)

৪.

বেসামরিক জীবনে ফেরত গেলেও যোদ্ধার জীবন আর কখনো পরিত্যাগ করেননি কাজী নূর-উজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে যে আগুন জ্বালিয়েছিল, তাতে সাড়া দিয়েই যুক্ত হয়েছেন কৃষক আন্দোলনে, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ লেখক শিবির ও সমাজচিন্তা সংঘে, প্রকাশ করেছেন নয়া পদধ্বনির মতো পত্রিকা। জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতায় আটকে না থেকে সমর্থন জুগিয়েছেন আদিবাসীদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি বন্ধের দাবিতে হরতাল ডেকেছেন জিয়ার আমলে, বিচারের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দিয়ে কারাগারে গিয়েছেন এরশাদ আমলে, মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলায় অন্যতম উদ্যোক্তা ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। কেন, কোন স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাটা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই নিষিদ্ধ আলোচনাটি সাহসের সঙ্গে তুলেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালালেরা কে কোথায় নামের আলোড়ন সৃষ্টি করা সেই প্রকাশনাটির পেছনের অন্যতম মানুষ কাজী নূর-উজ্জামান।

বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকগুলো নিয়ে যেদিন সত্যিকারের সাধনার উপযুক্ত পরিবেশ ইতিহাসবিদেরা পাবেন, কাজী নূর-উজ্জামানের জীবন, কাজ ও রচনাবলি তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আকর হিসেবেই বিবেচিত হবে। আজীবন মুক্তিসংগ্রামী হিসেবেই কাজী নূর-উজ্জামান বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসে, বারবার তিনি ফিরে আসবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রেরণা হয়ে। এমন সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়।

ফিরোজ আহমেদ লেখক, রাজনীতিবিদ