প্রবৃদ্ধি হিসাবের গরমিল দূর হবে কবে?

জাতীয় আয়ের হিসাব, গুণগত মান এবং স্থিতিশীলতা নিয়ে ঢিমেতালে কথাবার্তা হচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বৈষম্য আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই ধারা কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। অংশগ্রহণ বাড়লেও শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতের গুণগত মান প্রশ্নের সম্মুখীন।

অন্যদিকে সরকারি হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি তরতর গতিতে এগোচ্ছে। অর্থশাস্ত্রের প্রথম পাঠ অনুযায়ী, বিনিয়োগ, ভোগ, সরকারি ব্যয় এবং আমদানি-রপ্তানির সমষ্টিই জাতীয় আয় বা জিডিপি। এই চলকগুলোয় পরিবর্তন এলে জিডিপি কমে বা বাড়ে। এখানে প্রাথমিক চলকগুলোর সঙ্গে জাতীয় আয়ের হু হু প্রবৃদ্ধির দাবির তুলনা করা হয়েছে।

২.
বিনিয়োগ সঞ্চয় থেকে আসে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় এবং জাতীয় সঞ্চয় উভয়ই কমেছে। দেশজ সঞ্চয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জিডিপির ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ থেকে কমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয় জিডিপির ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমে ২৮ দশমিক ০৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের আয় কমেছে অথবা ভোগ ব্যয় এত বেড়েছে যে তাঁরা সঞ্চয় করতে পারছেন না বিধায় বিনিয়োগও বাড়বে না।

উপরন্তু, কয়েক বছর ধরেই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবিরতার খাদে খাবি খাচ্ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে। সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়েছে। মোটেও প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফন ধারার কাছে তেমন কোনো গতিরই না।
আবার পুরো সঞ্চয়ও বিনিয়োগে পরিণত হচ্ছে না। দিন দিন সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের মধ্যে ফারাক বাড়ছে। পুঁজি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলে বা পাচার হলে এই ফারাক বাড়ে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির হিসাবে ২০০৬-২০১৫ সময়কালে বাংলাদেশ থেকে ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়ে গেছে।

৩.
জাতীয় আয় এই হারে বাড়তে হলে ভোগ বাবদ ব্যয় থেকেই উল্লম্ফন ঘটতে হবে। সুতরাং পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই ভোগ বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির অংশ হিসাবে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ভোগ যথাক্রমে ৬ শতাংশ এবং ৬৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৬ এবং ৬৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে বেড়ে দাঁড়িয়েছে।

ভোগ বাবদ ব্যয় বাড়লে মানুষের প্রকৃত আয় বা ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার কথা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় আয় হিসাব অনুযায়ী, প্রকৃত জাতীয় আয় ২০০৯-১০ সময়কাল থেকে ২০১৫-১৬ সময়কালে ৪২ শতাংশ বেশি হয়েছে। এ সময়কালে প্রকৃত মাথাপিছু আয় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। সমানতালে ভোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথা ২০১৬ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ভিন্ন কথা বলে। ওই জরিপের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালের তুলনায় ব্যক্তিপ্রতি প্রকৃত আয় ২ শতাংশ কমেছে এবং ভোগের জন্য প্রকৃত ব্যয় প্রায় ১ শতাংশ কমেছে। প্রকৃত আয়ের সঙ্গে পুষ্টি গ্রহণের হারও সম্পর্কিত। জরিপ মতে, ২০১০ সালের তুলনায় পুষ্টি গ্রহণের হার ৫ শতাংশ কমে ২ হাজার ৩১৮ কিলোক্যালরি থেকে ২ হাজার ২১০ কিলোক্যালরিতে পৌঁছেছে। ২০১৯ সালে এসে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদন শিগগিরই প্রকাশিত হবে। পূর্ণাঙ্গ ডেটাসেট কবে প্রকাশ করা হবে? ভারতেও বেকারত্বের পরিসংখ্যানসংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না। ভারতের পত্রিকান্তরে জানা যায়, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও আইন অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা।

পরিসংখ্যান ব্যুরো কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের কর্মীদের প্রকৃত আয়ের সূচক প্রকাশ করেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মজুরি ২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ সময়ে ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এ সময়ে ভোক্তামূল্য সূচক বেড়েছে ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ। তাহলে ২০১০-১১-এর তুলনায় শ্রমিকদের প্রকৃত ৭ দশমিক ৯ শতাংশ আয় কমেছে (৩২ দশমিক ৬ শতাংশ-২৪ দশমিক ৭ শতাংশ)। ক্রমাগত উচ্চ প্রবৃদ্ধির হারের দাবি থাকলেও সাধারণ মানুষ আয় বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিতই হয়নি, বরং তাদের আয় খোয়াও যাচ্ছে।

জনগণের একটা বিরাট অংশ বেকার থাকায় ও বেকারত্ব বাড়ায় আয় করছে না। বিশ্বব্যাংক ও আইএলও বলছে, ১৫-২৯ বছর বয়সী না অধ্যয়নরত, না কোনো কর্মে ও না প্রশিক্ষণে নিয়োজিত যুবকের সংখ্যা ২০০৫ সালের শতকরা ৩১ ভাগ থেকে ১০ বছরে ১০ ভাগ বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বেকার যুবকের হারেও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। শতকরা ৯ দশমিক ৪৫ ভাগ। ব্রিটিশ কাউন্সিল বলছে, শিক্ষিত যুবকদের শতকরা ৪৭ ভাগ বেকার। শিক্ষিত মানুষের দক্ষতা বেশি, এই অনুমিতিতে তাদের আয় ও সঞ্চয় বেশি হওয়ার কথা থাকায় তা থেকেও দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। উপরন্তু, অধিকাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করায় মজুরি ও অধিকার দুই-ই কম।

আইএলও বলছে প্রকৃত মজুরি কমেছে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে প্রকৃত মজুরির প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২০০৮-১৭ সময়কালে বাংলাদেশের মানুষের গড় প্রকৃত মজুরির প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে কম (৩ দশমিক ৪ শতাংশ)। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার গড় হিসাব ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এই সময়কালে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার গড় প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫, ৪ দশমিক ৭ এবং ৪ শতাংশ ছিল।

গত শতাব্দীর আশির দশক থেকেই জনমানুষ গ্রাম থেকে শহরে ও বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গেছেন। আয়ের প্রায় পুরোটাই গ্রামে পাঠিয়েছেন, দারিদ্র্য কমেছে এবং ভোগ ব্যয় বেড়েছে। ভোগ ব্যয় বাড়ায় জিডিপির পরিসর বেড়েছে। এখানে সাম্প্রতিক সরকারের নীতি, কৌশলের তেমন ভূমিকা নেই। এটাকে ‘অটো পাইলট’ প্রবৃদ্ধি বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের সঙ্গে অভিবাসী আয় থেকে সৃষ্ট ভোগের অনুপাত বেশ আয়তনবিশিষ্ট হওয়ায় সরকারি কোনো ইতিবাচক নীতিগত হস্তক্ষেপ না থাকলেও বাংলাদেশে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি জায়মান থাকবে। কিন্তু বর্তমানে অভিবাসী আয়েও মন্দাভাব লক্ষণীয়। ২০১৫ সালে ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৬ সালে কমে ১২ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পরে সামান্য বেড়েছে।

জাতীয় আয় বাড়লে দারিদ্র্য কমার হারও বাড়ার কথা। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমার হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এই হার ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। অর্থাৎ দারিদ্র্য কমার হার কমছে। তাহলে জিডিপি বৃদ্ধির ফলাফল কোথায় যাচ্ছে?

৪.
জাতীয় আয়ের হিসাবের তৃতীয় অংশটি আসে আমদানি ও রপ্তানির নিট আয় থেকে। আমদানি ব্যয় সব সময়ই বেশি থাকলেও ২০১১-১২ অর্থবছরের ১৮ দশমিক ২ শতাংশের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পণ্যদ্রব্যের রপ্তানি-জিডিপি অনুপাত কমে হয়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। বাণিজ্য ও চলতি লেনদেনে ঘাটতি বাড়ছে। জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার কথা। রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণ এবং বৈচিত্র্য নেই। রপ্তানিতে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত হতে থাকা পোশাক খাতে রিটেনশনও খুব কম। ব্র্যান্ডগুলো নির্দিষ্ট কিছু রিটেইলার থেকে উপকরণ কিনতে বলে। মূল্য সংযোজন ২০ শতাংশের বেশি থাকে না। পোশাক খাতের অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি সামান্য বাড়লেও দক্ষদের প্রকৃত মজুরি কমেছে। ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে না পেরে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বাধ্যবাধকতায় অটোমেশন হলে অদক্ষ শ্রমিক চাকরি হারাবেন। আরেকটা বড় রকম কর্ম সংকোচনের সম্মুখীন হতে হবে।

৫.
সরকারি ব্যয় বাড়ছে প্রতিবছর। সিংহভাগই অনুৎপাদনশীল খাতে। অবকাঠামো ব্যয় সর্বাধিক। প্রকল্প ব্যয় বারবার বাড়ানো হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের খরচ বাড়তে বাড়তে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকাতে ঠেকেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, চার লেন সড়ক তৈরিতে কিলোমিটারপ্রতি ভারতে ১১ থেকে ১৩ লাখ ডলার ও চীনে ১৩ থেকে ১৬ লাখ ডলার খরচ হয়। বাংলাদেশে ৫০ লাখের চেয়েও বেশি লাগছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাত সবচেয়ে অবহেলিত। অবকাঠামোতে খরচ বাড়লেও গুণগত মান পড়ছে। বিদেশ থেকে জনশক্তি আনতে হচ্ছে। পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারত প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার অভিবাসী আয় হিসেবে পেয়েছে। ব্যক্তিপ্রতি স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার খরচ ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে ব্যক্তিপ্রতি স্বাস্থ্য খাতে খরচ মোট খরচের ৬৭ শতাংশ। ভারতে (৬২ শতাংশ), পাকিস্তানে (৫৬ শতাংশ), নেপালে (৪৭ শতাংশ), ভুটানে (২৫ শতাংশ)। খরচ বেড়েছে, মান বাড়েনি।
সংখ্যা এবং সমীকরণে অমিল লক্ষণীয়। পুরো পরিসংখ্যানে সবার প্রবেশাধিকার নেই। নিজেদের মতো উপস্থাপন করা হচ্ছে! যদি সংখ্যা ভাষা হয়ে ওঠে, তবে কী হবে? বাংলাদেশ ভাষার আন্দোলনেরই সূতিকাগার।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন