সুন্দরবনের মর্যাদা নিয়ে উদ্বেগ

বিশ্বপ্রকৃতির বিরলতম সম্পদগুলোর অন্যতম সুন্দরবন মানুষের অর্থকরী তৎপরতার আগ্রাসনে পীড়িত, ক্ষয়িত হচ্ছে বহু বছর ধরে। সাম্প্রতিক কালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা ধরনের শিল্পকারখানা স্থাপনের বিপুল আয়োজন চলছে, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদী বেয়ে দিনরাত চলাচল করছে পণ্যবাহী জলযান, আরও নানা বিচিত্র কর্মকাণ্ড চলছে সুন্দরবনের ভেতরে ও তার চারপাশজুড়ে। এসব তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ডের ফলে ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ইকো-সিস্টেম ও প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতির মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসব যে সুন্দরবনের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি, তা বোঝার জন্য খুব বেশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দরকার নেই।

দুঃখের বিষয়, আমাদের সরকার দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রবল জনমত ও গভীর উদ্বেগ অগ্রাহ্য করে সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ডগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের এপ্রিলে সরকার সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি শিল্পকারখানার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু সুন্দরবন তো শুধু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, সুন্দরবন বিশ্ব–ঐতিহ্যের অংশ। এর অস্তিত্বের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠন ও সংস্থা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের জন্য উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোকে চিঠি লিখেছিল। তারা ইউনেসকোকে পরামর্শ দিয়েছিল, সুন্দরবনের অদূরে রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা অন্যত্র সরিয়ে না নিলে সুন্দরবনকে যেন বিশ্ব–ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

আমাদের প্রকট আশঙ্কা, ৩০ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সুন্দরবন বিশ্ব–ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে। কারণ, ইউনেসকো সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশকে যেসব পদক্ষেপ নিতে বলেছিল, সেগুলো এমন মাত্রায় নেওয়া হয়নি, যা ইউনেসকো ও বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির কাছে সন্তোষজনক মনে হতে পারে। যেমন, সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য একটি কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা করার অঙ্গীকার ছিল, কিন্তু এখনো তা করা হয়নি। পরিবেশগত সমীক্ষা সম্পন্ন না করেই সুন্দরবনের আশপাশে শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

ইউনেসকো গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, সুন্দরবনের বিশ্ব–ঐতিহ্যের সম্মান অটুট রাখতে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বন্ধ রাখা এবং এর চারপাশের শিল্পকারখানার অনুমোদন না দেওয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রগতি খুবই ধীর। অন্যদিকে সরকার সুন্দরবনের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে, যা সুন্দরবনের জন্য আরও বড় হুমকি তৈরি করবে।

এই পরিস্থিতিতে খবর প্রকাশিত হলো ইউনেসকোকে বোঝাতে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল প্রথমে প্যারিস ও পরে বাকু যাবে। এর আগে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে পোল্যান্ডের ক্রাকোভ শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম সাধারণ সভার সময় বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ইউনেসকো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ওপর থেকে তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করেছে। পরে সরকারের তরফ থেকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলা হয়, রামপালের কাজ চালিয়ে যেতে কোনো বাধা নেই; ইউনেসকো বাংলাদেশের যুক্তি ও তথ্য মেনে নিয়ে এ ব্যাপারে তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে।

সরকারের এই বক্তব্য যে সঠিক ছিল না, তারই প্রমাণস্বরূপ এখন দেখা যাচ্ছে প্যারিস ও বাকুতে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠানোর তোড়জোড়। তাঁরা সেখানে ইউনেসকো ও বিশ্ব–ঐতিহ্য কমিটিকে কী বোঝাতে সক্ষম হবেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে আসলে কাউকে বোঝানোর কিছু নেই; বরং সুন্দরবনের ঝুঁকি কমানোর দিকেই বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।